প্রায় দেড় বছর আগে চুরির অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জব্বার মোল্লা। জব্বারের বয়স তখন ছিল ৬৭ বছর। অভিযোগ, তিনি ৫০ বছর ধরে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে চুরি করেন।
পুলিশ বলেছে, ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়া এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বিভিন্ন বাসাবাড়িকে চুরির লক্ষ্যবস্তু বানান। তাঁরা মূলত দুটি বিষয় দেখে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করেন। এক. যে বাসায় দারোয়ান নেই। দুই. যে বাসায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা নেই।
প্রায় একই সময়ে ডিবির হাতে চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন আজিজুল হক ফকির নামের এক ব্যক্তি।
ডিবির ভাষ্য, আজিজুল মাদারীপুরের একটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তিনি একটি চোর চক্র গড়ে তুলেছেন। এই চক্রের সদস্যরা সন্ধ্যার পর কার বা পিকআপ নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান।
এই চক্রের সদস্যরাও দুটি বিষয় দেখে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করেন। এক. কোন বাসায় রাতে আলো জ্বলছে না। দুই. সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এড়িয়ে চুরি করা সম্ভব কি না।
বোঝা গেল, দুটি চোর চক্রই যে বাড়িতে নিরাপত্তা কম থাকে, সে বাড়িকে চুরির লক্ষ্যবস্তু করে। পুলিশ বলছে, আবার কোনো কোনো চক্র বাড়ির ভেতরে শৌখিন ঝাড়বাতি আছে কি না, সেটি লক্ষ্য করে। চোর চক্র মনে করে, এ ধরনের ঝাড়বাতি যে বাসায় আছে, ওই বাসায় সোনা ও নগদ অর্থ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ঈদের ছুটিতে অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান। এ সময় বিভিন্ন এলাকায় বাসায় গ্রিল কেটে চুরি বেড়ে যায়। চুরি হওয়া বাড়িগুলোয় সাধারণত সিসিটিভি ক্যামেরা থাকে না, আলো জ্বলে না ও দারোয়ান থাকে না।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো ঘটনায় চোর চক্রের সঙ্গে গৃহকর্মীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এ ধরনের গৃহকর্মীরা এক বাসায় বেশি দিন কাজ করে না। ঈদের আগে কোন বাসা ফাঁকা থাকবে ও কোন বাসায় কী ধরনের সম্পদ রয়েছে, সে তথ্য চোর চক্রকে দেন গৃহকর্মীরা। তাই পরিচয়পত্র, মুঠোফোন নম্বর যাচাই করে কিংবা পরিচিত কারও মাধ্যমে গৃহকর্মী নিয়োগের পরামর্শ দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পুলিশের নিরাপত্তাব্যবস্থা চুরি ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। পুলিশ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। পাশাপাশি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের সতর্ক থাকতে হবে। ঘরের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকার কোন এলাকায় কত চুরি
ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে সিঁধেল চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে, ৫৪৭টি। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৮২টি এবং ২০২২ সালে ৭১৩টি।
যদিও ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত চুরির ঘটনা অনেক বেশি। শুধু রেকর্ডভুক্ত চুরির হিসাব এই পরিসংখ্যানে এসেছে। অনেক সময় ভুক্তভোগী মামলা করতে চান না। আবার অনেক সময় পুলিশও মামলা নেয় না। আর সিঁধেল চুরি বলতে ঘরে সিঁধ কেটে চুরিকে বোঝায়। কিন্তু ঢাকার বাসাবাড়িতে চুরি হয় মূলত গ্রিল কেটে বা বাসার তালা ভেঙে। মূলত বাসাবাড়ির চুরির ঘটনাগুলোকেই সিঁধেল চুরি বলা হচ্ছে।
অপরাধ বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সিঁধেল চুরির মামলা হয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। এই বিভাগে মামলা হয়েছে ৯৯টি। এরপরই সবচেয়ে বেশি ৯৫টি মামলা হয়েছে মতিঝিল বিভাগে। এর বাইরে ৭০ এর অধিক মামলা হয়েছে ওয়ারি, গুলশান ও মিরপুর বিভাগে।
৫০ বছর ধরে চুরির অভিযোগে জব্বার ও তাঁর ছয় সহযোগীকে গ্রেপ্তারের সময় ডিবি গুলশান বিভাগের ডিসির দায়িত্বে ছিলেন রিফাত রহমান শামীম। তিনি এখন গুলশান বিভাগের ডিসির দায়িত্বে আছেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গুলশান বিভাগের মধ্যে ভাটারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং বাড্ডা এলাকার বাসাবাড়িতে বেশি চুরি হয়। এসব এলাকার অনেক বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। চোর চক্রের সদস্যরা এ ধরনের বাসাতেই চুরির জন্য ঠিক করেন। যাঁরা ঢাকা ছাড়ছেন, তাঁরা অবশ্যই বাসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। প্রতিবেশী এবং নিরাপত্তাকর্মীকে বাসার দিকে নজর রাখার জন্য বলে যাওয়া উচিত।
ডিসি রিফাত রহমান শামীম আরও বলেন, অনেক সময় গ্রামে যাওয়া পরিবারের স্বজন পরিচয়ে অনেক ব্যক্তি বাসায় যেতে চায়। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাকর্মীকে অবশ্যই বলে যেতে হবে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কাউকে বাসায় যেতে দেওয়া যাবে না।
চুরি ঠেকাতে ডিএমপি কমিশনারের পরামর্শ
ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে রাজধানীবাসীকে ১৩টি নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। এর মধ্যে পাঁচটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বাসাবাড়ির নিরাপত্তা এবং চুরি ঠেকাতে করণীয় বিষয়ে। গত শুক্রবার এই নির্দেশনাগুলো বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজের আগে ইমামেরা প্রচার করেছেন। চুরি ঠেকাতে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনাগুলো হলো—
১. বাসাবাড়িতে সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসাতে হবে। আগে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরা সচল আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করতে হবে।
২. বাসার চারপাশে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৩. নগদ টাকা কিংবা স্বর্ণালংকার ব্যাংক কিংবা নিকটাত্মীয়দের কাছে নিরাপদে রাখতে হবে।
৪. রাতে কিংবা দিনে একসঙ্গে মুখে মাস্ক এবং মাথায় ক্যাপ পরিহিত অপরিচিত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গতিবিধি নজরদারি করতে হবে। প্রয়োজনে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিতে হবে।
৫. মোটরসাইকেল চুরি রোধে অ্যালার্ম লাগাতে হবে। এতে কেউ মোটরসাইকেল স্পর্শ করলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে। লক করার কাজে স্টিলের তৈরি মেরিন অ্যাংকর চেইন ব্যবহার করতে হবে। মোটরসাইকেলে জিপিএস ট্র্যাকার লাগাতে হবে এবং চাকাতে উন্নতমানের ডিস্ক লক ব্যবহার করতে হবে।