অলংকরণ: আরাফাত করিম
কমতুলি গ্রামের যে টিলাটিকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল, পরদিন সকালে সেখানে এসে দয়াল কৃষ্ণের পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে যায়। গাছের মগডালে ঝুলছে একটা ছিন্নভিন্ন পা। দৃশ্যটি দেখেই তার চোখ পুড়ে গেল। সে ঝিম মেরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। নড়ার শক্তি তার ছিল না। গুলিগোলার নির্মম আঘাতে আশপাশের মাটি, গাছপালা এমনকি লতাগুল্ম পর্যন্ত ঝাঁঝরা হলেও সেসব ছাপিয়ে কেবল এই একটি দৃশ্যই তার চোখে আজীবনের জন্য স্থির হয়ে গেল। জীবনে এমন দৃশ্য সে কখনো দেখেনি। দৃশ্যটা তার চোখ থেকে আর কিছুতেই সরে না। মন থেকেও নয়। দৃশ্যটা মুহূর্তেই মাথার ভেতরে সুড়ুৎ করে ঢুকে পুরো মাথায় জেঁকে বসল। এরপর দিন যেতে থাকে, একসময় মাথায় ঢুকে পড়া দৃশ্য থেকে ছিন্নভিন্ন পা-টা আলাদা হয়ে খুবই ধীরে টের না পাওয়া গতিতে নেমে এসে তার কাঁধে চেপে বসল। তাই বুঝি দয়াল কৃষ্ণ বুঝতে পারে, কয়েক দিন যেতেই মাথাটা হালকা হয়েছে বটে, কিন্তু কাঁধে যেন কিসের ভার। দিন যায়, ভারটা আর নামে না। এভাবেই তার বয়স বাড়তে থাকে।
সে ভাবে, পা-টা নিজে নিজে আকাশে উড়তে গিয়েছিল? নাকি উড়ে গিয়ে গাছের মগডালে আটকা পড়েছিল? কে জানে। ওখান থেকে আর নামতে পারেনি। ইপিআরের খাকি পোশাক তখনো খানিকটা লেগে ছিল গায়ে। শিশু যেমন কোনো উঁচু জায়গা থেকে নামার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, তেমনিভাবে তার দিকে আকুতি নিয়ে চেয়ে আছে।
এ তো যেনতেন কোনো পা নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাগুলোর একটি। কিন্তু সে যা–ই হোক, তাতে দয়াল কৃষ্ণের কিই–বা এসে যায়? সে কি আর এ পায়ের মাহাত্ম্য জানে? কেবল পা-টা যখন মাঝেমধ্যে তাকে খোঁচায়, তখন তার মনে এই প্রশ্নগুলোই বারবার ফিরে আসে:
: কে এই পায়ের মালিক?
: কী নাম তার?
: কোথায় তার বাড়ি?
: কে তার মা-বাবা?
কোনো উত্তর না পেয়ে একসময় তার প্রশ্নগুলো পানিশূন্যতায় ভোগা কচি চারার মতো নেতিয়ে পড়ে অনির্দিষ্ট সুপ্তিতে চলে যায়। কিন্তু মরে না।
কমতুলি গ্রামের উল্টো দিকে পূর্ব তীরে, চেঙে নদীর পাড়ে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার আদাম (গ্রাম)। নাম ভাঙামুরো। সে ঘর থেকে বেরিয়েছিল খেতের পুরোনো ভাঙা বেড়া নতুন করে বোনার জন্য ভাইজ্যা বাঁশ কাটতে। বাঁশের জন্য যেতে হয় হ্রদের পাড়ে। চৈত্র মাস, জল শুকিয়ে চেঙে নদী এখন খাড়া দুই তীরের মাঝখানে এসে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছে। দুই পাশে ভাঙা পাড়। তার ভেতর দিয়ে বয়ে চলে ঘোলা জল। নদীতে পানি দুই-দেড় মানুষ–উচ্চতার কম নয়। বর্ষা এলে চারদিকে টইটম্বুর জলে নদীর অস্তিত্ব মুছে যাবে।
এপ্রিলের ৮ তারিখে আকস্মিক যুদ্ধটা যখন শুরু হয়, তখন দয়াল কৃষ্ণ বাঁশ কাটা ফেলে ভয়ে দৌড়ে পাশের টিলায় উঠে যায়। তার মনে হচ্ছিল, গুলিগোলা সব তার মাথার ওপর ফাটছে। সে জুতসই দেখে একটা গুটগুট্ট্যা গাছে উঠে পড়ে। গাছের উঁচুতে ঝোপের আড়াল নিয়ে নিজেকে নিশ্চিত করতে চায় যে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। তখন কাছাকাছি কোথাও গুলিগুলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকে। দু–একটা তার বসে থাকা ডালের নিচ দিয়ে পাশ কাটিয়ে শিস দিতে দিতে কিছুটা দূরে চলে যায়।
দুপুরের আগে ঘণ্টাখানেক পর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেলে সে গাছ থেকে নামে। এদিক–ওদিক না তাকিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে আসে। ভয় তখনো তার কাটেনি। চারদিক সুনসান। আদামের অধিকাংশ লোক পালিয়েছে। আদামে ঢুকেই সে মুখোমুখি হয় একদল অপরিচিত লোকের। কারও হাতে, কারও কাঁধে অস্ত্র-গোলাবারুদ। কোনটার কী নাম, সে জানে না। গাছের ওপর থেকে এদের কমতুলি থেকে চেঙে নদী পার হয়ে এদিকে আসতে দেখেছে। বুঝতে পারল, ওরা মুক্তিবাহিনীর লোক। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চায়। এদের দু–একজন তাকে দেখেই চিনতে পারলে তার মনের ভেতর ঘিরে ধরা ভয়ের কুয়াশাটা কেটে যায়।
সপ্তাহখানেক আগে সে এদের একটা দলকে নানিয়াচর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এখন আবার সেই দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। শ খানেক যোদ্ধার দল। দয়াল কৃষ্ণ তার ছোট ভাই জ্যোতিষ চন্দ্রকে ডেকে আনে। দুই ভাই রওনা দেয় পথপ্রদর্শক হিসেবে।
এ ঘটনার পঁচিশ বছর পরে ভুলতে থাকা ছিন্ন পা-টা তার ভেতরে আবার জেগে ওঠে। একদিন খবর পায়, বিডিআরের লোকজন তাকে খোঁজাখুঁজি করছে। সংবাদটা শুনে তার গলার পানি শুকিয়ে যায়। সে বারবার ঢোঁক গেলার চেষ্টা করে; কিন্তু শুকনো ঢোক, গলার অর্ধেকে এসে আটকে যায়। নিচে নামে না। মনে মনে চিন্তা করে খিঁচে একটা দৌড় দেবে নাকি?
দয়াল কৃষ্ণের বৃদ্ধ কপালে কচি ঘাম জাগে। এই বৃদ্ধ বয়সে তার কী হবে? সে তো শান্তিবাহিনীর কেউ না। শান্তিবাহিনীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক কোনো কালে ছিল না, নেইও। এমনকি তার ছেলেপুলে ভাই-ভ্রাতা কিংবা নিকটাত্মীয় কেউ না। সে কোনো রকমে দিন এনে দিন খাওয়া গরিব চাষা। সরকার কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছুর সঙ্গে সে একদমই জড়িত না। কে তার এত বড় সর্বনাশ করল? কে গিয়ে আর্মি, বিডিআরের কাছে তার বিরুদ্ধে লাগিয়েছে? নির্মম জেলজীবনের কথা চিন্তা করে তার মাথা ঘুরতে থাকে। জেলে দেওয়ার আগে চলতে পারে ধোলাই। কিন্তু একটা মাইরও তো সে সহ্য করতে পারবে না। স্রেফ মারা যাবে। সেটাই ভালো হবে। পঙ্গুত্ব নিয়ে যন্ত্রণাকাতর বেঁচে থাকার চেয়ে মরাই ভালো।
বিডিআরের দলনেতা তাকে একটা ছবি দেখায়, আর জানতে চায়, লোকটাকে সে চেনে কি না। নাম মুন্সি আবদুর রউফ। দয়াল কৃষ্ণ জীবনের সব স্মৃতির পাতা ওল্টাতে থাকে, কিন্তু সফল হয় না। কোনোভাবেই সে এ নামের কারও কথা মনে আনতে পারে না। বুড়িঘাট বাজার কিংবা নানিয়াচর বাজার কিংবা রাঙামাটির দু–একজন পরিচিত বাঙালি কিংবা কাপ্তাই হ্রদের কিছু মাছ ব্যবসায়ী ,নয়তো গাছ ব্যবসায়ী কিংবা ইঞ্জিন বোটের ড্রাইভারসহ খুব কমসংখ্যক বাঙালির কথাই সে মনে করতে পারে।
এবার বিডিআরের দলনেতা তাকে একাত্তরের সেই যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তারপর একে একে বর্ণনা করে কে সেই মুন্সী আব্দুর রউফ। কেন সে এত গুরুত্বর্পূণ, কেন আজ মৃত্যুর এত বছর পরে রাষ্ট্র তার খোঁজ নিচ্ছে। দয়াল কৃষ্ণ টের পায় যে তার কাঁধটা আবার ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছে। ছিন্নভিন্ন সেই বেনামি পা-টা জেগে গেছে। পা-টা চুপি চুপি তাকে বলে, ‘কি বুড়ো, এবার চিনতে পারলি তো, আমি কে?’
দয়াল কৃষ্ণ গিয়ে দেখিয়ে দেয় বীরের জীবনদানের সেই পুণ্যস্থান। ছিন্ন পা-টি কোথায় পুঁতে দিয়েছিল, সেই জায়গাটা। তখনই নিজেকে তার অত্যন্ত হালকা লাগতে শুরুর করে। এতদিনে পা-টা তার কাঁধ থেকে নেমে গেল।
এ ঘটনার পরেই দয়াল কৃষ্ণের জীবনটা বদলে গেল। ইতিহাসের পাতায় একজন বীরের সঙ্গে তার নামটাও যুক্ত হয়ে পড়ল। এখান–ওখান থেকে বিভিন্ন সাহায্য–সহযোগিতার আশ্বাস আসতে শুরু হয়েছে। কিছু টাকাকড়িও পেয়েছে। কেউ কেউ প্রশাসনের কাছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম ওঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ কেউ তো তাকে একেবারে উঠিয়ে ছেড়েছে।
প্রতিশ্রুতির এ বিষয়টা প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন আর তাকে আন্দোলিত করে না। বিভিন্ন উপলক্ষে মাঝেমধ্যে হাজার কিংবা পাঁচ শ টাকা বকশিশ পায়—এটাকেই সে কপাল বলে মানে। কেবল পা-টার বকবকানিটাই সে বন্ধ করতে পারে না। আগের চেয়ে আরও বেশি মুখরা হয়ে উঠেছে। যখন–তখন তাকে কানে কানে বলে ওঠে, ‘কি বুড়ো, আমার সাথে তোরও তো কপাল খুলে গেল, বিখ্যাত হয়ে গেলি।’
ছিন্ন পা-টা কথাগুলো বলার সময় হয়তো মুচকি হাসেও। চেহারা কখনো দেখেনি বলে দয়াল কৃষ্ণ হাসিমুখের ছবিটা মনের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। তার চোখে কেবল মগডালে আটকে থাকা সেই দৃশ্যই ভাসে। পরিপাটি পোশাক পরে সমাধির সিঁড়িতে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে জবাব দেয়, ‘চুপ চুপ, ওই দেখ স্পিড বোটগুলো আসছে তোর জন্য ফুলের ডালা নিয়ে। আমার ভাগ্যে হয়তো নগদ কিছু জুটবে, এতেই আমি খুশি।’