এত মানুষ, কিন্তু কোলাহল নেই। নীরবে সবাই যে যার আনন্দ করছে। এত বড় একটা পিকনিক স্পটে এসে মাইক বাজতে না দেখে বাঙালি হিসেবে একটু অবাক হলাম। বড় একটা ওকগাছের তলায় সাজানো আসনে বসে খাবার সেরে নিলাম। এখানে আসব বলে মেয়ে খুব ভোরে উঠে ছাগলের মাংসের বিরিয়ানি বানিয়েছে। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘাসের বিছানায় বসে নদীর অবিরাম কলকল শুনছিলাম। চোখ বন্ধ করে ফেলে আসা পথের নানা দৃশ্য আর পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ওকোনালুফটির পথচলা প্রত্যক্ষ করছিলাম। প্রকৃতির লীলাভূমি চেরোকির রহস্যময় ধূমায়িত পাহাড়গুলো যেন ইশারায় ডাকছে। গাছগুলো তাদের বহুবর্ণী পাতা নেড়ে নেড়ে আমায় তাদের ঘ্রাণ নিতে বলছে। আমি কান পেতে রইলাম। যেন শুনতে পেলাম পর্বতের চূড়ার বাসিন্দা নুন্নেই জাতিগোষ্ঠীর কোনো প্রবীণের প্রার্থনাসংগীত।
রেড ইন্ডিয়ান এক শিশুর হর্ষধ্বনিতে আমার ঘোর কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্নতা কেটে গেল। স্বচ্ছ পানির ওপর পাথর ছুড়ে দিয়ে সে মজা নিচ্ছিল। পাথরের আঘাতে পানি লাফিয়ে উঠে কয়েক ফোঁটা আমার মুখও ছুয়ে গেল। শিশুটির দিকে হাসি মুখে তাকালাম। এখানেই কোথাও রয়েছে রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রাম। তার মা আমার দিকে মিষ্টি হেসে শিশুর এমন আচরণে লজ্জা প্রকাশ করলেন। শিশুটি ততক্ষণে পানিতে নেমে গেছে। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। শীতল পানি। হাঁটু পর্যন্ত নেমে আঁজলা ভরে নিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললাম।
দ্বীপের বাঁশবনছবি: লেখকের সৌজন্যে
মনপ্রাণজুড়ানো একটা অনুভূতি নিয়ে পানি থেকে উঠে হাঁটতে লাগলাম। বিভক্ত হয়ে যাওয়া নদীর একটি ধারার পাশে নিবিড় বাঁশবন। বাঁশের উচ্চতা ৪০ ফুটের ওপর। বাঁশঝাড়ে বাতাস এসে লাগলে শোনা যায় শর শর ধ্বনি। পানির সুরের সঙ্গে সেই ধ্বনি মিশে এক মিলিত কোরাস সংগীতের সৃষ্টি করে। আমরা বাঁশবনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে দেখি পর্যটকদের আনাগোনা। এখানে পথ চলতে হয় সাবধানে। মাটি ফুঁড়ে কাঁটার মতো উঠে আসছে বাঁশের শিশু। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার জনপ্রিয় সবজি বাঁশকোঁড়ল। এখানেও চল আছে কি না ভাবতে ভাবতেই দেখি একটি পরিবার বাঁশকোঁড়ল সংগ্রহ করছে। বাইরের আবরণটা ফেলে ভেতরের সাদা শাঁসটুকু বের করে তার ছেলেমেয়েদের খেতে দিচ্ছে। আমরা তো রান্না করে খাই। এরা তো দেখি কাঁচাই খেয়ে ফেলছে। ওদের খেতে দেখে শুভ (মেয়ের বর) জানতে চাইল, স্বাদ কেমন?
নারী উত্তর দিলেন, কোনো স্বাদ নেই। মিষ্টি, তিতা, টক, নোনতা কিছুই না।
তবে খাচ্ছ যে? এর কি কোনো খাদ্যগুণ আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ এর ভেতরে ভিটামিন ডি, সি আছে, এটা রুচি বাড়ায়।
বললাম, আমাদের দেশে এটা একটা জনপ্রিয় সবজি। আমরা রান্না করে খাই।
তিনি খুশিতে ওয়াও বলে আমাদের কয়েক টুকরো খেতে দিলেন। সাগ্রহে মুখে নিলাম। নরম অথচ কোনো স্বাদ নেই। উল্টা গলা চুলকাতে লাগল। মহিলাটি তাকিয়ে আছে কি না দেখলাম। তারপর বাঁশবনের দিকে ছুড়ে মারলাম।
একটি নদী, তার দুটি ধারা। যমজ বোনের মতো অবিরাম মানুষকে গান শুনিয়ে চলেছে। গ্রীষ্মে আমাদের দেশে সন্ধ্যা হয় সাতটার দিকে। আর এখানে সাড়ে আটটার পর। এ রকম একটা পরিবেশে বিকেল যতই প্রলম্বিত হয়, ততই ভালো লাগে।