কোন দিন কোন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে, আগেই আমাদের জানানো হয় সেই শিডিউল। ৮ মার্চের সূচিও সেভাবেই জেনেছি। বিমানের বিজি-৩৪৯ ফ্লাইট নিয়ে সৌদি আরবের দাম্মাম যাব। ক্যাপ্টেন আলিয়া মান্নানের সঙ্গে আমি ফার্স্ট অফিসার (সহপাইলট) হিসেবে থাকব। ককপিটের এই দায়িত্ব কয়েক বছর ধরেই পালন করছি। ককপিটে একসঙ্গে দুজন নারীর দায়িত্ব পালন বিমানে হরহামেশাই হয়ে থাকে। আলিয়া মান্নানের মতো জ্যেষ্ঠ পাইলটের সঙ্গে আমি বিভিন্ন রুটে গিয়েছি। তাই সেদিনের এই ফ্লাইট পরিচালনার ব্যাপারটিও আমার কাছে আর দশটা যাত্রার মতোই ছিল।
৮ মার্চ সকালে দায়িত্ব বুঝে নিতে গিয়ে জানতে পারি, নারী দিবস উপলক্ষে এই ফ্লাইটকে ঘিরে বিশেষ কিছু হচ্ছে। কেবিনে নারীরাই শুধু দায়িত্ব পালন করবেন। সবাইকে নিয়ে ফটোসেশনও হলো। স্যাররা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। সংবাদকর্মীদের বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারার অনুভূতি জানালাম।
বিমানবন্দরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। শুধু ককপিট আর কেবিন নয়, গ্রাউন্ডের সব দায়িত্বও মেয়েরা পালন করছে। মানে ফ্লাইটের কেবিন ক্রু শিডিউলিং, ককপিট ক্রুদের ব্রিফিং, প্যাসেঞ্জার চেক-ইন কাউন্টার, ফ্লাইট কভারেজ, গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার সবাই নারী। আনন্দে মনটা ভরে গেল।
উড়াল দেওয়ার আগে আমাদের ব্রিফিং করেন ফ্লাইট ডিসপাচার। সেদিন কাজটা করলেন বিমানের প্রথম নারী ফ্লাইট ডিসপাচার জান্নাতুল ফেরদৌস। বিজি-৩৪৯ ফ্লাইট কোন রুটে দাম্মাম যাবে, আবহাওয়া কেমন, বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন কোন বিমানবন্দর ব্যবহার করা যাবে ইত্যাদি কারিগরি বিষয় তিনি দক্ষতার সঙ্গে ব্রিফ করলেন। সবকিছু বুঝে নিয়ে আমরা চললাম। মাঝে অন্য বিভাগের নারী সহকর্মীদের সঙ্গে ছবি তুললাম। মনে হচ্ছিল যেন ফ্লাইট নয়, কোনো উৎসবে শামিল হয়েছি।
শুধুই নারীদের তত্ত্বাবধানে বিমানের এটিই প্রথম ফ্লাইট। প্রতিটি ধাপেই দায়িত্ব পালন করবেন নারীরা। সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ী এক সিদ্ধান্ত।
গ্রাউন্ডের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিজি-৩৪৯-এর ককপিটে উঠে বসি আমরা। দুজন পাইলটের এখানে দুই ধরনের দায়িত্ব—পাইলট ফ্লাইং (পিএফ) বা বিমান পরিচালনা, পাইলট মনিটরিং (পিএম) বা যাবতীয় পর্যবেক্ষণ ও যোগাযোগের দায়িত্ব। এ যাত্রায় আমি পাইলট মনিটরিংয়ের (পিএম) দায়িত্বে আছি। বেলা আড়াইটায় আমাদের ওড়ার কথা। যথাসময়েই দাম্মামের উদ্দেশে উড়াল দিল আমাদের বিমান।
আকাশে উড়তে উড়তে মনে পড়ল অনেক কথা। আমার বাবাও পাইলট ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। জীবন নিয়ে অনেকের কত পরিকল্পনা থাকে। প্রথম স্বপ্নটা আলোর মুখ না দেখলে দ্বিতীয়টা নিয়ে এগোয়। কিন্তু আমার একটাই স্বপ্ন ছিল, ককপিটে বসা। তাই এইচএসসি পাস করেই ঢাকার আরিরাং ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে থেকে পড়াশোনা শেষে একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসে যোগ দিই। এরপর ২০১৭ সালে যোগ দিই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে।
বিমানে এখন আমি চতুর্থ এয়ারক্র্যাফট পরিচালনা করছি। পদোন্নতি পেয়েই বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের মতো উড়োজাহাজ চালাই। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে এসে কোনো দিন মনে হয়নি নারী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হয়েছি বা বাড়তি সুবিধা পেয়েছি। আসলে প্রতিটি ধাপে পরীক্ষা দিয়ে, নিজেকে প্রমাণ করেই এ পর্যন্ত এসেছি। নারী-পুরুষের এমন সমতা আছে বলেই এই পেশা আমার কাছে আরও মর্যাদার।
ঢাকা থেকে ভারতের ভোপাল, আহমেদাবাদের আকাশসীমা পেরিয়ে আরব সাগরের ওপর দিয়ে আমরা তখন সৌদি আরবের আকাশে ভাসছি। আর একটু পরই দাম্মাম বিমানবন্দরের পৌঁছাব। তার আগে আগে আমরা বুঝতে পারলাম আবহাওয়া খারাপ করেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু নয়। ক্যাপ্টেন আলিয়া মান্নানের দক্ষতায় নিরাপদেই রানওয়ে ছুঁল বিজি-৩৪৯।