28 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০, ২০২৫

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ আলিফের বাবা বয়স ১৫ হওয়ার আগেই ঝরে গেল ছেলেটা

‘বেঁচে থাকলে সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ ছেলেটার ১৫ বছর পূর্ণ হতো। কিন্তু তা হওয়ার আগেই ঝরে গেল ছেলেটা’—কথাগুলো বলছিলেন ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ হওয়া সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফের বাবা সৈয়দ মো. গাজীউর রহমান।

তিনি বলেন, একমাত্র সন্তানকে হাফেজ করতে ছোটবেলায় মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম। কোরআনে হাফেজ হতে পারেনি, কিন্তু মাদ্রাসা থেকে এ প্লাস পেয়ে দাখিল (এসএসসি) পাশ করে। আলিম প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পর বললাম, ‘চলো গ্রামের বাড়ি নাঙ্গলকোট ঘুরে আসি, কিন্তু ছেলে বলে, ‘বাবা আমাকে কম্পিউটার আর ইংরেজি ভাষা শিখতে কোচিংয়ে ভর্তি করে দাও’। আমি ছেলের কথামতো ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোচিংয়ে দুই বিষয়েই ভর্তি করিয়ে দিই। সেই কোচিং থেকে বন্ধুরা মিলে আন্দোলনে যাওয়া শুরু। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ আরও অনেকে যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়, তারপর থেকে ছেলে চুপি চুপি আন্দোলনে যেত, আমরা জানতাম না। যখন জানলাম, ছেলে আন্দোলনে যাচ্ছে, তখন আমি খুব শঙ্কিত ছিলাম। এত বাচ্চারা আহত-নিহত হচ্ছে, আমার একটাই ছেলে, ‘ওর যদি কিছু হয়ে যায়’! সেই আশঙ্কাই থেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আলিফের এক কথা—‘মরে গেলে যাব, তবু আন্দোলনে যাব। বড় ভাইদের প্রাণ যাচ্ছে, আমি ঘরে বসে থাকব না’।

আলিফ আন্দোলনে শেষ যায় ৫ আগস্ট। সেদিন ছেলেকে ঘরে তালা দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তার পরেও শেষ রক্ষা হলো না। অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যখন যাচ্ছিল, তখন রাগ করে ছেলেকে উপরিউক্ত কথা বলেছিলাম। ৫ আগস্ট যখন আলিফ আন্দোলনে গেল, দুপুরের পর জানলাম, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু বিকাল হয়ে গেলেও আলিফ বাসায় আসছিল না, ওর বন্ধুদের দু-এক জনকে ফোন করে জানতে চাইলাম, আলিফের কথা। বন্ধুরা জানালো, ‘আঙ্কেল চিন্তা কইরেন না, অনেকে তো আজ শাহবাগ, গণভবন গেছে, হয়তো আলিফও ওদিকে গেছে’। কিন্তু আমি বললাম, সব রাস্তা বন্ধ, ও শাহবাগ যাবে কী করে?

এরপর সন্ধ্যায় বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং হচ্ছিল—যেখানে যেখানে লাশ পড়েছিল—‘এত বছর বয়সের ছেলের লাশ পাওয়া গেছে’। আমি গেলাম দুই জায়গায়, দেখি না আমার ছেলে নয়। এরপর স্থানীয় হাসপাতালে গেলাম, ওরা জানাল, মারাত্মক আহত যারা, তাদের আমরা ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেখানে খোঁজ নিতে পারেন। ওর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের দিকে রওনা হই। কিন্তু সেদিন রাতে পথে পথে ব্যারিকেড আর গোলাগুলি চলছিল, তখন যাত্রাবাড়ী থানা লুট হয়ে গেছে, সড়কে ভয়াবহ অবস্থা। আমরা যখন ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছাই তখন রাত আনুমানিক ১২টা।

বাবা গাজীউর বলেন, আমার এক চাচাতো ভাই ঢাকা মেডিক্যালের ব্রাদার। ওকে ডেকে নিই। ঐদিন ঢাকা মেডিক্যালের গেট থেকে ইমার্জেন্সি পর্যন্ত রক্ত আর রক্ত। মর্গের সামনে একটা ঘরে অসংখ্য লাশ স্তূপ করে রাখা। ঐ ঘরের মেঝেতে দাঁড়াতেই রক্তে পা ডুবে যায়। এর মধ্যে দেখি কারো মাথায় পতাকা বাঁধা, কারো শরীর পতাকায় ঢেকে দেওয়া। এর মধ্যে হঠাৎ চোখ যায়, লাশের স্তূপের ভেতর, একটা হাত দেখা যাচ্ছে। গায়ে কালো টি-শার্ট। আমি ঐ ঘরের দায়িত্বে থাকা লোকদের বলি লাশটা দেখাতে, কিন্তু তারা বলেন, আপনি কনফার্ম হলে আমরা দেখাব, তা না হলে দেখানো যাবে না। এত লাশ ওলটপালট করা যাবে না। আমি আরও কিছুক্ষণ দেখে নিশ্চিত হই এটাই আমার ছেলের লাশ হবে। ছেলে বাসায় ব্যায়াম করত, তার সুঠাম বাহু এবং সাদা পায়জামা ও কালো টি-শার্ট দেখে বলি ‘আমি কনফার্ম’। আপনারা আমাকে মুখটা দেখান। ওরা বলে, মাথায় গুলি লাগা, এরপর ওরা আমার ছেলের লাশটা বের করে দেয়। কিন্তু লাশের গায়ে কোনো নম্বর বা অন্য কিছু ছিল না। ওরা বলে, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমার চাচাতো ভাই বলার পর ওরা আমার ছেলের লাশ দেয়। অ্যাম্বুলেন্সের চালক বলেন, ‘এত রক্তমাখা লাশ, ধুইয়ে নিয়ে যান, তা না হলে অনেকে গোসল দিতে চাইবে না’। তখন ছেলের লাশ সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টামে নিয়ে যাই। ওরা গোসল দিয়ে কাপড় পরিয়ে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ চায়। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া তারা লাশ দেবে না। তখন তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বন্ডসই দিয়ে ছেলের লাশ নিয়ে আসি। যাত্রাবাড়ীর বাসায় যখন পৌঁছাই তখন ভোর ৪টা। সেখানে আলিফের মাকে নিয়ে আমরা ভোরেই গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্ট চলে যাই। জোহরের নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে ছেলেকে দাফন করি।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ সংবাদ

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ

0
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে হাজার খানেক শিক্ষার্থী তিতুমীর কলেজ...

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নতুন ডিজি কাউসার নাসরীন

0
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব (সংযুক্ত) কাউসার নাসরীন। সোমবার (১৮ নভেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখার সিনিয়র...

শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত

0
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে পাসগুলোর কার্যকারিতা থাকবে না। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি...

সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গ্রেফতার

0
ঢাকা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার (১৮ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তরা-১২ নম্বর...

‘শেখ হাসিনা নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন, তবে বাস্তবতা ভিন্ন’

0
ভারতে বসে শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যগুলো বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে...