বিভাজন-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে যে মূল্য দিতে হয়েছে বিশ্বের খুব কম জাতিগোষ্ঠীই সেই মূল্য দিয়েছে। একাত্তরে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের ওপর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের যে ভয়, বীভৎসতা ও নারকীয়তা নেমে এসেছে তা বর্ণনাতীত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাষা আন্দোলনের চেতনারই সম্প্রসারণ। ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বা ব্যবধান হলো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনে বিশ্বাস। এ কারণে দেশভাগের পর পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা বিশ্বের খুব কম জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য। একাত্তরে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের ওপর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের যে ভয়, বীভৎসতা ও নারকীয়তা নেমে এসেছে তা বর্ণনাতীত।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জীবনের বিবর্ণ ও প্রতিকূল বাস্তবতাকে বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক নানা ও বহু-রৈখিক উপায়ে রূপ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও এই প্রচেষ্টা চলছে। কালের ব্যবধানে সমগ্র বাঙালি জীবনের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ ও অর্জনকে নির্মাণ ও বিনির্মাণ করা সহজ নয়, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে সহজ। মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে শত্রুর বর্বরতা ও নতুন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাস ও চেতনার প্রত্যক্ষ শিল্পরূপ তৈরি করা কঠিন। আর শিল্পকলার সবচেয়ে কঠিন কাজে সাহসী ভূমিকা পালনকারী কবিদের মধ্যে জসীমউদ্দীনই সবচেয়ে প্রবীণ।
একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোতে জসীমউদ্দীন স্বদেশে থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত রক্তে স্নান দেশের জন্য কবিতা লেখেন। কবিতা তার কাছে অস্ত্র ছিল। তখন তার কবিতার প্রতিটি শব্দ শত্রুর বিরুদ্ধে ছোড়া বুলেটের মতো। তারপর তার কবিতার প্রতিটি লাইন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব-জনমত সৃষ্টির এক কঠিন ও কঠিন প্রক্রিয়ার মতো। জসীমউদ্দীন মূলত জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুনেছেন, যুদ্ধরত জাতির প্রতি বিশ্ব বিবেকের সহানুভূতি এবং স্বদেশের সমৃদ্ধ চেতনা তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতায় তুলে ধরেছেন। তুজম্বর আলী ছদ্মনামে ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকায় কবিতা পাঠান। আমেরিকা ও রাশিয়ায় বহু কবিতা অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়েছে। একারণে মুক্তিযুদ্ধে জসীমউদ্দীনের কবিতা শুধু শিল্প মাধ্যমই নয়, কাব্যচর্চার চেয়েও বড় কিছু। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সরাসরি জড়িত জসীমউদ্দীনের সেসব কবিতার মূল্য ঐতিহাসিক।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জসীমউদ্দীনের প্রথম কবিতা ‘বঙ্গবন্ধু’। 16 মার্চ 1971 তারিখে লেখা। প্রকৃতপক্ষে ৭ই মার্চের পর বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একত্রিত হওয়ার ঘটনা, বাঙালির হাজার বছরের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির দূত হিসেবে অধিষ্ঠিত শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালির মুকুটহীন মহারাজা, কবিকে করেছেন আশাবাদী ও উজ্জ্বল। এই চেতনার কবির কাব্যিক স্ফুলিঙ্গ হল ‘বঙ্গবন্ধু’; যা একতা, প্রতিশ্রুতি ও মহিমায় উন্নীত ।