পৃথিবীজুড়ে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা এসে গেছে। ইতোমধ্যে আমি ছোটবেলার ১০ থেকে ১২ জন বন্ধু হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে ২ জন বন্ধু শহীদ হয়েছে। এখন প্রতিবছর কমছে; কভিডের সময় অনেকে গত হয়েছে।
ছোটবেলায় আমার ঈদ কেটেছে একটু অন্যরকম। এক সুন্দর সংস্কৃতিতে আমি বড় হয়েছি। সিলেটের মণিপুরি রাজবাড়িতে আমার বেড়ে ওঠা। সেখানে বেশির ভাগ পরিবার ছিল মণিপুরি, কিছু হিন্দু ও আমরা কয়েক ঘর মুসলমান। পূজা-পার্বণে প্রত্যেকের বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল। ধর্মীয় উৎসবগুলো আমরা সত্যিকার অর্থে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারতাম। তা কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের উৎসব হয়ে থাকত না। আমরা অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতাম। যেমন তারাবির নামাজ পড়া, রোজা রাখা ইত্যাদি। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমিও মসজিদে যেতাম। আমরা ছোটবেলায় হজরত শাহজালালের মাজারে যে মসজিদটি রয়েছে, সেখানে ঈদের নামাজ পড়তাম। বাবার নেতৃত্বে আমরা সব ভাই সেই মসজিদের নামাজ পড়তে যেতাম। আমার দায়িত্ব ছিল জায়নামাজগুলো বহন করা। আমি সে দায়িত্ব খুব সুচারুভাবে পালন করতাম। এগুলো আমার এখনও খুব ভালোভাবে মনে আছে। নামাজ থেকে ফিরে এসে আমাদের থাকত অনেক স্বাধীনতা। যা ইচ্ছা তাই করতাম। আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম। তাই মাঠে খেলতে যেতাম।
সব সম্প্রদায় মিলে আমাদের আনন্দের উপলক্ষগুলো আনন্দদায়ক হতো। এটি আমার জীবনের বড় অভিজ্ঞতা ছিল। যখন দেখতাম ঈদের আনন্দে অন্যরাও শামিল হচ্ছে; যে কোনো ধর্মের অনুসারী দরিদ্র ব্যক্তিরা বাড়িতে এসে খেতে পারছেন, এটা আমার কাছে খুব মানবিক মনে হতো। আমি মনে করি, আমরা ধর্মের মানবিক দিকটা দেখে বড় হয়েছি। অসহিষ্ণু দিকটা কখনও আমরা দেখিনি। সহিষ্ণুতা, মানবিকতা, পরস্পর সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ– এগুলো আমাদের ছোটবেলায় একান্ত আবশ্যিক মূল্যবোধ বলে বিবেচনা করা হতো। সেই দিক থেকে আমার ছোটবেলার সময়টা অনেক বেশি আনন্দঘন ছিল।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মানুষের মধ্যে লোভটা কম ছিল; বাহুল্য ছিল না। ঈদের সময় পুরুষরাই কেবল বাজার করতেন। স্ত্রী, ভাই-বোন, মা-বাবার জন্য কাপড় কিনতেন। প্রতিবেশীদের মধ্যেও সুসম্পর্ক ছিল।
বর্তমানে সমাজে বাহুল্যের প্রাবল্য আমি দেখতে পাচ্ছি। এর পাশাপাশি দরিদ্রদের প্রতি আমি ছোটবেলায় যে সহানুভূতি দেখেছি, তা এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। আমাদের সময় রেডিওতে জাকাত দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেওয়া হতনা। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাকাত দিতেন। এখন জাকাত দেওয়ার জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিতেও দেখেছি। মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। আগে তো সেটা ছিল না। এখন মানুষের অনেক সম্পদ বেড়েছে। আগে মানুষের সম্পদ ছিল সীমিত, কিন্তু দেওয়ার মানসিকতা ছিল অনেক বেশি। এখন নেওয়ার ও জমা করার মানসিকতা বেড়েছে; দেওয়ার ইচ্ছা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এই দুটো পরিবর্তন আমি দেখতে পাচ্ছি। বাহুল্যের চর্চা; কাপড়চোপড় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি যে, তা বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখাতে হচ্ছে। এ জিনিসিটা আগে ছিল না। ইফতার নিয়ে কীভাবে পার্টি হয়? এটা আমি কখনও দেখিনি। আজকাল সেহরি পার্টিও হয়! ছোটবেলায় আমার বাবা আর শিক্ষকরা বলতেন– রোজার মাসে খাবে অর্ধেক, আর কাজ করবে দ্বিগুণ। এটাই তোমার শিক্ষা। এখন ঠিক উল্টো।
ধর্মীয় উৎসবের যে অসাম্প্রদায়িক দিক ছিল সেটাও আজ খুব সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে আমি খুব শঙ্কিত! কারণ আমাদের যারা নীতিশিক্ষা দিতেন; মসজিদের ইমাম, শিক্ষকরা খুবই ভালোমানুষ ছিলেন। সত্য কথা বলতে, বড়দের সম্মান করতে, ছোটদের স্নেহ করতে, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দিতেন। কারও মনে আঘাত না দিতে বলতেন। এসব বিষয় ছোটবেলা থেকে আমাদের মনে ঢুকে গিয়েছিল। এর মানে এই নয় যে, আমরা দুষ্টুমি করতাম না। অনেক দুষ্টুমি করতাম। তবে মানুষকে ঠকাতাম না। দুয়েকবার হয়তো কোনো বাড়ির ফল নিয়ে দৌড় দিয়েছি। রোদে শুকাতে দেওয়া আচারের বোতল খুলে কিছুটা খেয়ে ফেলেছি। এগুলো ছিল ছোটখাটো বিচ্যুতি। বড় অর্থে আমরা কখনও নৈতিকতা বিসর্জন দিইনি, কিংবা কারও বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করিনি। এখন দেখতে পাচ্ছি, যারা নীতিশিক্ষা দেবেন, তারাই তো নেই। সেই শিক্ষকরাও নেই, সেই পরিবারগুলোও বিচ্ছিন্ন। আর যখন পরিবারগুলো লোভে পড়ে যায়, তখন স্বার্থপরতা ঢুকে পড়ে। স্বার্থটাই বড় হয়ে যায়। মানুষ যখন নৈতিকতা ভুলে যায়, তখন সেই মানুষের ধর্ম পালনেও পবিত্রতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পবিত্রটা হলো ফুলের মতো; গন্ধ ছড়ায়। পবিত্র মানুষ সামনে এলে আপনি টের পাবেন। সুগন্ধির মতো!
যদি কোনো মানুষের মধ্যে অখণ্ডতা না থাকে, সেই মানুষ যদি কাউকে আদেশ বা নিষেধ করে; তা কে শুনবে? আমরা কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টা কখনও কল্পনাও করতে পারিনি। একটা পরিবারের মধ্যে সুস্থতা থাকলে সেখানে মাদকতা আসবে কেন! আমাদের দেশে একটা অসুস্থ লোভের চর্চা চলছে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের শিক্ষকদেরও সতর্ক হওয়া উচিত।
ছোটবেলায় আমরা যা দেখেছি, বড় হয়েও সেগুলো বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। এখনও আমরা সকলের কাছে ঈদের শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছি, বন্ধুরা বিজয়ার শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে, বুদ্ধপূর্ণিমার শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। আমরা এগুলো স্বাভাবিক বলে ধরে নিতাম। এখন সেগুলো কমছে। এই ধারা বজায় রাখতে পারলে সমাজের জন্য কল্যাণকর। কারণ সব ধর্মই মানুষের মঙ্গল সাধনের কথা বলে। সব ধর্মের উৎসবের একটাই সুর– আনন্দ আর মানুষে মানুষে সম্প্রীতি। সেই সঙ্গে যদি দরিদ্র মানুষের প্রতি আমাদের সহানুভূতি থাকে; তাদের প্রতি দায়িত্ব যথাযথ পালন করি তাহলে আনন্দ পরিপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধনীরা যদি বুঝতে পারেন– দরিদ্রদের কারণেই তাদের সব সম্পদ, তাহলে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে। সমাজে এখনও এই বোধটার অভাব রয়ে গেছে।