নারী হলো ধরিত্রীর এক অংশ। পুরাণের রামায়ণে সীতা, মহাভারতের দ্রৌপদী; ইতিহাসের ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই, রানী দুর্গাবতী; প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সরোজিনী নাইডু এবং মাতঙ্গিনী হাজরা; এনাদের জীবন সংগ্রাম আমরা পুরাণের ও ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। মারগারেট থ্যাচার, ইন্দিরা গান্ধী, কিরণ বেদীদের জীবনসংগ্রাম আবার অন্য রকম। আসলে প্রত্যেকে নারী পরিচয়ে বড় হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন সময়ে, পরিবেশে।
সীতারামের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে বিয়ের পর বনবাসে চলে গেলেন ১৪ বছরের জন্য, রাজ্যে ফিরে এসেও তাঁকে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হলো শুধু পবিত্রতার প্রমাণ দিতে; দ্রৌপদীর একই নির্মম লিখনে সুখের সময়টা অতিবাহিত করতে হলো বনবাসে। বনবাস পর্বের প্রারম্ভে তাঁকে কেন্দ্র করে এ পুরাণের কাহিনি ওলটপালট হয়ে গেল। নারী বলে তাঁকে দুর্যোধনের মতো চরিত্রের কাছে লাঞ্ছিত হতে হলো।
নারী বলে তাঁদের জীবনগাথা বেদনাদায়ক হতে হবে, সমাজের সব লাঞ্ছনা, দুঃখ সব তাঁদের জন্য পূর্বনির্ধারিত। স্বাধীনতা–পূর্ববর্তীকালে নারীদের জন্য অবগুণ্ঠন, বাধাবিপত্তি সমাজের তৎকালীন সমাজপতিরা ঠিক করতেন। বিয়ে থেকে শুরু করে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত সবটাই জীবন খাতায় তাঁরাই ঠিক করতেন। এ জন্য নারীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতেন, বাল্যবিবাহ ও সতীদাহের মত ঘৃণ্য কাজ তাঁদের উপরেই করা হতো।
দিবসটা নারীদের। নারী জীবনের ধরিত্রী, নারী এ ধরণীর জীবন স্পন্দনের ধারক ও বাহক। আমাদের সমাজ কী অদ্ভূত, যিনি জীবনদানের ভিত্তিপ্রস্তর রচনার বাস্তুকর, তাঁদের জন্য দিবস, সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সহনশীলতা দিয়ে কৃতী কর্মযোগী ভারতমাতার সন্তান গড়লেন যে জন্মদাত্রীরা—চিত্ন্যদেব, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, চিত্ত্রঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র বসুদের ছত্রছায়ায়। নারী দিবস ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় কী প্রতীকী। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী প্রতীকী নাকি মিথ তার প্রমাণ আমাদের ইতিহাস। নারী শুধু মাতা হিসেবে প্রসিদ্ধ নন, নারী মানে অর্ধাঙ্গিনী। সাবিত্রী ও দময়ন্তী ঐতিহাসিক নারী চরিত্রগুলো সহধর্মিণীর ভূমিকায় মিথ। তবু নারী প্রতীকী হিসেবে চিহ্নিত। আমরা আজও তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থানে নারী দিবস যুক্তিযুক্ত নাকি প্রাসঙ্গিক। নারীকে আজও বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় আকর্ষকের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। এমনকি প্রতিদিনের সংবাদপত্র ও সংবাদে নজর রাখলে দেখা যাবে নারীরা কীভাবে হিংস্র প্রবণতা ও লালসার স্বীকার হচ্ছেন। পণ্য হিসেবে নারীকে ব্যবহার করার প্রাসঙ্গিকতা বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয়তার দাবি রাখে। পেশার আহ্বানে পেশাদারিত্বের দাবিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ও মানসিকতার পরিবর্তনই নারীর হাতিয়ার। নারী আজ পুরুষের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে, চোখে-চোখ রেখে আর মুন্সিয়ানার সঙ্গে সমানতালে পুরুষের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলেছে।
নারী আজ বিমান, রেল চালাচ্ছে; মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছেন; সেনাবাহিনীতে পুরুষের পাশাপাশি দেশের সীমান্ত প্রহরায় সদাব্যস্ত। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কৃতী আইপিএসের (কিরণ বেদী) ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার নজির ভারতীয় নারী দেখিয়েছেন। এমনকি ইসরোর বিজ্ঞানী হিসাবে সংসার ধর্ম পালন করেও যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। ইতিমধ্যে রাজনীতিতেও রাজ্যের সফল মুখ্যমন্ত্রীর উজ্জ্বল নারী হিসেবে বিশ্বের মঞ্চে সমাদৃত হয়েছেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীরা কম যান না, ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামী, জিমন্যাস্টে দীপা চক্রবর্তী জলন্ত উদাহরণ। নারীদের জন্য আলাদা কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না তাঁদের অবদান স্মরণের জন্য। নারীর পরিচয় সে নিজেই। এইতিহাসিক যুগ থেকে দেখছি জননী হিসেবে নদের নিমাই খ্যাতি শচীমাতার সৌজন্য; বিবেকানন্দের খ্যাতি মা ভুবনেশ্বরীর কল্যাণে। সহধর্মিণী হিসেবে কিংবদন্তি চরিত্র সাবিত্রী ও দময়ন্তী, তাঁরা আজও উদাহরণ। ভগিনী বা সহযোদ্ধা হিসেবে (প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার) ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে সমানে সমানে সংগ্রাম চালিয়েছেন। প্রাক্-স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগে চিকিৎসাবিদ্যায় কৃতী নারী কাদম্বরী দত্ত। পরবর্তী সময়ে আইনশাস্ত্রে পদ্মা খাস্তগীর। নারী দিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য বোধহয় এসব নারীর কৃতিত্বের কাছে ম্লান হয়ে যায়। নারী দিবসকে ছোট না করে বলা যায় নারীর তুলনা নারী নিজেই। একই অঙ্গে সে মাতা, অর্ধাঙ্গিনী, ভগিনী ও সহযোদ্ধা। পদার্পণ তার সর্বত্রই, আলাদা করে নারীর জন্য কোনো দিবস প্রতীকী হিসেবে পালন করে তাঁকে ছোট করা যাবে না, তেমনি তার পদচারণা অবরুদ্ধ করা যাবে না কোনো অংশে। নারী সৃষ্টির প্রতীক যেমন কৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক। সাহিত্যিক ঝুম্পা লাহিড়ি বোধহয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জাতীয় ক্ষেত্রে আশাপূর্ণা দেবী ও মহাশ্বেতা দেবী অনন্যতার পরিচয় দেখিয়েছেন। সমাজসেবী মেধা পাটেকারের নর্মদা আন্দোলনে জড়িত নামটি অনন্য নারীর স্বাক্ষর বহন করে। নারীর সম্মান ইত্যবছরে ভূলুণ্ঠিত এ প্রশ্ন আজকের নয়। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মহাকাব্য রামায়নে সীতার অগ্নিপরীক্ষা রামরাজ্যেও হয়েছিল। আবার নীতিবাগীশ মহাকাব্য মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের লজ্জাস্কর অধ্যায় সম্ভবপর হয়েছিল। নারী গতকাল ও নিরাপদ ছিল নয়া আগামীতে নিরাপদ কি না, সেই জিঘাংসার নিষ্পত্তি ঘটাবে আমাদের সমাজব্যবস্থা। লালসার স্বীকার নারী আবার উদ্যাপনের প্রতিভূ। ভারতীয় সমাজব্যবস্থার কী মেলবন্ধন। ভারতীয় সমাজ নারীকে যৌবনে লালসার স্বীকার করেছেন, আবার ভগিনী ও মাতা হিসেবে তাঁর স্বরূপ প্রকাশিত। দৃষ্টিভঙ্গি যত দিন না বদলাচ্ছে, নারীর মূল্যায়ন সঠিকভাবে ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় সম্ভব নয়। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র নারীর মূল্যায়ন সঠিকভাবে দেখাতে পেরেছিলেন; নারীর অবস্থান কী, কোথায় ও কেমন করে রয়েছে। নারী দিবসের মূল্যায়ন শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক দূরদর্শিতাই উপযুক্ত দিগদর্শী হয়ে উঠেছে। নারী দিবসের মাহাত্তব যদি মূল্যায়িত হতো তবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নির্ভয়া কাণ্ড ঘটে চলত না। নারী দিবস পালিতই হয় কিন্তু এখনো ভারতের নারীকে সহমরণে যেতে হয়, নাবালিকার বিবাহবন্ধন বা পরিণয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
বিধবাদের জীবনগাথা ছিল সম্পূর্ণ একটা নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো। সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ ছিল দুরস্ত। শুধু দিনক্ষয় ছাড়া জীবনযাপনের কোনো অর্থ ছিল না। বিধবা মানে সাদা থানের নিথর মানবীরূপের আধার, দিন গোনা ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে’। দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হতো নামগানের মধ্যে দিয়ে।
নারী কিন্তু আজ অবলা নয়, নারী আজ প্রতিবাদী; যে চুল বাঁধে, সে দুর্গার মতো ১০ অবতারে সংসারের জোয়াল সামলে, পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কর্মজগতে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে চলেছে। নারী আজ চন্দ্রায়ন–৩ (৫১ জন নারী বিজ্ঞানী) এর অভিযানে পুরুষের সঙ্গে কাজ করেছেন দেশকে পৃথিবীর বুকে সম্মানজনক স্থান এনে দিতে।
নারী দিবস প্রশ্ন রাখে ফেলে আসা দিনের সেসব নারীর জন্য, যাঁরা সমাজের কাছে নিষ্পাপ হয়েও কেন তাঁরা এ ফল ভোগ করলেন। নারী দিবস কী তাহলে পুরুষের প্রায়শ্চিত্তের দিন, নাকি এ দিনে শুধু নারী অধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারের দিন মাত্র। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিয়ে থাকি তাই, তবে আমরা কি সর্বস্তরে নারীকে তাঁর অধিকার দিতে পেরেছি?