15 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১৬, ২০২৫

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, ট্যানারি, মসজিদ ৯ হাজার গলির এই শহরে আছে ।

উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শহরের প্রাচীন অংশকে বলে মদিনা। আমরা জানি মদিনা শব্দের একটা অর্থ নগর। এ কারণেই হয়তো এমনটা বলা হয়। মরক্কোর ফেজ শহরেও এমন একটা অংশ আছে। সেই মদিনা–ই দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় মাথার ওপরে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। ফেজের এই অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো শহরগুলোর অন্যতম। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

এই মদিনার ভেতরে কোনো যান্ত্রিক যানবাহন চলে না। হেঁটেই চলাচল করে মানুষ। আর মাল টানার কাজ করে গাধা বা ঘোড়া। পুরোনো শহরের ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে বাইরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দরজা দিয়ে ঢুকতেই মনে হলো মধ্যযুগের কোনো শহরে চলে এসেছি। হাঁটার সময় বারবার মনে হচ্ছিল ৯ হাজার গলির এই শহরে না আবার হারিয়ে যাই। এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেলেই মনে হয় ফেজ আর ফেজের ইতিহাসকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যাবে।

ফেজের এই অংশটাকে ফেজ আল বালিও বলা হয়ে থাকে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দোকান। মাঝেমধ্যে বাঁশের বেড়ার ছাদ। ফাঁক দিয়ে রোদের আলো ঢুকে একধরনের আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করেছে। বিভিন্ন মসলার দোকান, কাঠের সামগ্রীর দোকান, সিরামিকের কারুকাজ করা সামগ্রীর দোকান, কী নেই। লোকজনও বেশ আন্তরিক, হাসিমুখে আমাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। কিছু দরকারি আরবি কথা শিখে রেখেছিলাম। ওদের সঙ্গে সেগুলো বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, আমার কথা বুঝে ওরা যে উত্তর দিত, সেটা বোঝার মতো এলেম আবার আমার ছিল না। তারপর কিছু ইশারায়, কিছু ইংরেজিতে বলে বুঝতাম।

প্রথম উটের মাংস খেলাম

ফেজের পুরোনো শহরের গেট থেকে নানা অলিগলি দিয়ে আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছালাম। এটি রিয়াদ নামে পরিচিত। এটি ঐতিহ্যবাহী মরোক্কান বাড়ি, উঠানে বাগান আছে। রুমে বাক্সপেটরা রেখেই বের হলাম দুপুরের খাবারের খোঁজে। ইচ্ছা উটের মাংস খাব। কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে মরক্কোর বিখ্যাত তাজিন (কুসকুস, সবজি, মাংস আর মসলা সহযোগে তৈরি খাবার) আর উটের মাংসের বার্গার দিয়ে পেট ভরলাম। জীবনে প্রথম উটের মাংস খেলাম। ভালোই লাগল।

রেস্তোরাঁ থেকে একটু সামনেই বউ ইনানিয়া মাদ্রাসা। মারিনিদ শাসনামলে ১৩৫৫ সালে তৈরি হয় এই মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি তৈরি করা হয় মারিনিদ ও মরোক্কান স্থাপত্যের সংমিশ্রণে। ভ্রমণকারীদের কাছে মাদ্রাসার মূল আকর্ষণ এর উঠান, কাঠ, প্লাস্টার ও সিরামিকের অসাধারণ কারুকাজ। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত, ইসলামিক জ্যামিতিক নকশার কারুকাজের মধ্যে মধ্যযুগের শৈল্পিক সমৃদ্ধি বোঝা যায়। উঠানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মন ভরে দেখলাম সুন্দর আর সূক্ষ্ম সব কাজ, শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে। মাদ্রাসার সঙ্গেই মসজিদ। অন্য ধর্মের ভ্রমণকারীরা শুধু উঠান পর্যন্ত ঘুরে দেখতে পারলেও মুসলমানদের জন্য পুরো স্থাপনাটিই উন্মুক্ত। মাদ্রাসার ঠিক উল্টো পাশের বাড়িটিতে (দার আল-মাগানা) খেয়াল করলে দেখা যায়, একটি জলঘড়ি। এ ধরনের জলঘড়ি পৃথিবীতে আর বেশি নেই। দুঃখের বিষয় হলো, ঘড়িটি এখন আর চলে না। এটি কীভাবে কাজ করত, সেটা আর কেউ জানে না।

জিলাপির মতো দেখতে চেবাকিয়া

এক মিষ্টির দোকানে দেখি, জিলাপির মতো দেখতে একধরনের মিষ্টি সাজিয়ে রাখা। আরবিতে এর নাম চেবাকিয়া। কয়েক পিস কিনলাম। স্বাদও অনেকটা জিলাপির মতোই। দোকানিকে বললাম, এই খাবার তো আমাদের বাংলাদেশের, তোমরা কীভাবে পেলে! তাকে জিলাপির ছবিও দেখালাম। ছবি দেখে সে অবাক। জানাল, এই মিষ্টান্ন তাদের স্থানীয় ও বেশ বিখ্যাত। জিলাপি কি তবে মরক্কো থেকে আমাদের এখানে এল! নাকি আমাদের এখান থেকে ওদের ওখানে গেল।

এসব ভাবতে ভাবতেই চলে গেলাম আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চালু বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই মসজিদ। পর্যটকেরা শুধু মসজিদ দেখার সুযোগ পান। মসজিদটির নকশাও অনেকটা বউ ইনানিয়া মাদ্রাসার নকশার মতো। এই মসজিদের ভেতরেও শুধু মুসলিম ভ্রমণকারীরা ঢুকতে পারেন। অন্য ধর্মের দর্শনার্থীরা একটা দরজা দিয়ে ভেতরটা দেখতে পান। আমরা ভেতরে ঢুকে বরাবরের মতোই অভিভূত হলাম। উঠানে পানির ফোয়ারা আছে। এখানেই সবাই অজু করেন। এই মসজিদের সিরামিকের কাজের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য প্লেস সাফারিন। জায়গাটা ধাতব কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত। ফেজের সাধারণ জীবনযাত্রার একটা ধারণাও এখানে পাওয়া যায়। এখানকার দোকানগুলোয় কারিগরদের তামা ও পিতলের কাজ করতে দেখা যায়, জটিল অলংকার থেকে শুরু করে রান্নাঘরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করেন তাঁরা। ক্রমাগত হাতুড়ির শব্দ আর কারিগরদের কর্মকাণ্ডের দৃশ্য দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। এখান থেকে আমরা বেশ কিছু তামার সামগ্রী কিনলাম। আমাদের দেশের মতোই দরদাম করতে হয়। এক দোকানি তো আমাকে বলেই বসল, তোমরা তো বেশ দামাদামি করতে পারো। আমি জবাব দিলাম, তুমি আমাদের দেশে গেলে তোমাকেও দোকানদার একই কথা বলবে!

ফেজে আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য ছিল চৌয়ারা ট্যানারি। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ট্যানারি। একাদশ শতাব্দীর এ ট্যানারিটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে। শ্রমিকেরা এখানে প্রাচীন পদ্ধতিতে পশুর কাঁচা চামড়া শোধন করে পাকা চামড়ায় পরিণত করেন। দর্শনার্থীরা আশপাশের বিভিন্ন উঁচু বাড়িঘরের বারান্দা থেকে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ দেখতে পারেন। তবে এখানে চামড়ার গন্ধে বেশিক্ষণ টেকা যায় না।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ সংবাদ

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ

0
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে হাজার খানেক শিক্ষার্থী তিতুমীর কলেজ...

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নতুন ডিজি কাউসার নাসরীন

0
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব (সংযুক্ত) কাউসার নাসরীন। সোমবার (১৮ নভেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখার সিনিয়র...

শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত

0
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে পাসগুলোর কার্যকারিতা থাকবে না। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি...

সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গ্রেফতার

0
ঢাকা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার (১৮ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তরা-১২ নম্বর...

‘শেখ হাসিনা নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন, তবে বাস্তবতা ভিন্ন’

0
ভারতে বসে শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যগুলো বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে...