[ছবি সংগৃহিত]
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশি নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও কারাভোগ করেন; ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা-বন্দী হিসেবে ঢাকা ও ফরিদপুর কারাগার থেকে আন্দোলনকারীদের নির্দেশনা দিয়ে ভাষা আন্দোলনে পরোক্ষ অবদান রাখেন। যদিও বায়ান্নতে তাঁর ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা নিয়ে বদরুদ্দীন উমরসহ অনেকেই ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থ প্রকাশসহ ভাষা আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও দলিলপত্র পর্যালোচনা করলে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়, অর্থাৎ ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট থেকে ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। এ সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, চিকিৎসক, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এবং আত্মীয়স্বজন। ১৯৫১ সালের ১৩ নভেম্বর সকাল ৯টায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আনোয়ারা খাতুন এমএনএ, খয়রাত হোসেন এমএনএ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইনসহ প্রায় ৩০ জন মেডিকেল ছাত্র। ১৯৫১ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান। তিনি সকাল সোয়া ৯টা থেকে পৌনে ১০টা পর্যন্ত কথা বলেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, আজিজ আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। এসব তথ্য জানা যায়, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন থেকে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ব্যক্তিগত খোঁজখবর নেওয়া ছাড়াও রাজনৈতিক নির্দেশনা গ্রহণের জন্য রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতারা তাঁর সঙ্গে বারবার কারাগারে সাক্ষাৎ করেন। এদিকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তখন চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একত্র হয়ে আন্দোলনের করণীয় ঠিক করতে দফায় দফায় বৈঠক করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে আয়োজিত সভায় গঠন করা হয় ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এর আহ্বায়ক হন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুব। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং আন্দোলন পরিচালনার জন্য নিরাপত্তা-বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতাদের বারবার নির্দেশনা দেন। কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন: ‘জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়।…আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, নাইমউদ্দিন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহমদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরও অনেকে গোপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।’ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালন ছাড়াও একটি প্রস্তাবে নিরাপত্তা-বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি জানানো হয়।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর ভাষা আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান অতিমাত্রায় রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করলে সরকার তাঁকে এবং সহবন্দী মহিউদ্দিন আহমেদকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে স্থানান্তর করে। যাত্রাপথে নারায়ণগঞ্জের ছাত্রনেতারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হলে তাঁরা ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর কারাগারে অনশন শুরু করলে ভাষা আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। বিভিন্ন পত্রিকা মারফত এ সংবাদ প্রচারের পর আন্দোলনকারীরা তাঁদের মুক্তির দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে লিফলেট প্রকাশ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয়। ওই লিফলেটে মুসলিম লীগ সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে অভিহিত করে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়। এর আগে আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, মওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতা তাঁদের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁদের মুক্তির দাবিতে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বক্তব্য দেন শামসুল হক চৌধুরী, নাদেরা বেগম, জিল্লুর রহমান প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে মুক্তির দাবিসংবলিত পোস্টার লাগানো হয়।
ঢাকার বাইরেও ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে একই দাবি উচ্চারিত হয়। মূলত বঙ্গবন্ধুর অনশন ও অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই সময় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন একদিন ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফর শেষে ঢাকায় ফিরছিলেন, নরসিংদী রেলস্টেশনে মতিউর রহমান নামের এক ব্যক্তি তাঁকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের অনুরোধ জানান। এ ছাড়া যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ স্লোগান ওঠে। যশোরের ইতনার প্রতিবাদ সম্পর্কে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় এক চিঠিতে বলা হয়: ‘ইতনা, যশোর, ১৭ ফেব্রুয়ারি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের মুক্তির দাবিতে ইতনা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রহমান সাহেবের অসুস্থতার দিক লক্ষ করিয়া ছাত্রনেতা জনাব সিরাজুল ইসলাম বলেন, খোদা না করুক, যদি মি. রহমানের অকাল মৃত্যু হয়, তা হইলে জনসাধারণ গদিধারীদের ক্ষমা করিবে না।…আমাদের কোনো দাবী যদি গদিওয়ালারা না শোনেন তাহা হইলে তাহাদের মনে করাইয়া দেই যে, “এক মাঘে শীত যায় না।” …জনসাধারণ আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ, শেখ মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ ধ্বনিতে সভা ত্যাগ করেন। সভায় হাজার হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন।’ কেবল সভা-সমাবেশ নয়, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদেও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি তোলা হয়। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তাঁর অনশন বিষয়ে আলোচনার জন্য আইন পরিষদে মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন আনোয়ারা খাতুন এমএলএ।
এদিকে ভাষা আন্দোলনকারীদের দমনে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশ থেকে ছাত্ররা তা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ অভিমুখে যাত্রা করে। ওই দিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না-জানা অনেকে। ২১ ফেব্রুয়ারি কারাগারে অনশনরত অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু ঢাকায় হতাহতের খবর পান। সেদিন ফরিদপুর কারাগারের গেটে গিয়ে পিকেটাররা স্লোগান দেয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে ঢাকার যুবলীগ অফিসে একটি টেলিগ্রাম আসে দপ্তর সম্পাদক আনিসুজ্জামানের কাছে। তাতে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদ একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের খবর পেয়ে তাঁদের মুক্তির দাবির সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদও যুক্ত করেছেন।
তাঁদের অনশনে দেশময় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে সরকার ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে গ্রামের বাড়িতে হাজির হন। এরপর এক বিবৃতি দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের ঘটনায় মর্মাহত হওয়ার কথা জানান এবং শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তিনি পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হয়রানির নিন্দা জানান। গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত অবস্থায় পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে তাঁকে স্থানীয় পুলিশ কঠোর নজরদারিতে রাখে। কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং নব-উদ্যমে রাজনীতি শুরু করেন। তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হন এবং ভাষা আন্দোলন ও একুশের চেতনা প্রসারে কাজ করেন।
২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা প্রতিনিধিদের সভায় যোগ দেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে ধরেন। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের মুক্তির দাবি জানান এবং পুলিশের গুলিতে হতাহতের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সেখানকার সুধীমহলে ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর বিবৃতি আদায় করেন।