26 C
Dhaka
সোমবার, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫

বিডিআর ট্র্যাজেডির ১৫ বছর : বিচারকস্বল্পতায় শুনানি হচ্ছে না

দেড় দশক আগে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর (পরিবর্তিত নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত অপেক্ষায়। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, এই মামলাটির শুনানির জন্য আলাদা একটি বেঞ্চ প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে বর্তমানে বিচারক আছেন ছয়জন, যা পর্যাপ্ত নয়। বিচারক নিয়োগ হলে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে মামলাটির শুনানি করা হবে।
আজ থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ হয়।
পিলখানায় নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা। দুই দিনব্যাপী ওই বিদ্রোহে নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় বিডিআরের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত অনেক কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। বেসামরিক ব্যক্তিসহ এ ঘটনায় মোট ৭৪ জন প্রাণ হারায়। তখন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল জওয়ানদের বিদ্রোহ।
সেই প্রেক্ষাপটে বিডিআর নাম বদলে বাহিনীর নাম রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। 

এই বিদ্রোহের ৫৭টি মামলার বিচার বাহিনীর নিজস্ব আদালতে শেষ হয়। সেই বিচারে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদণ্ড হয়। বিদ্রোহের বিচারের পর ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনকে আসামি করা হয়।
দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি সবচেয়ে বড় মামলা। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। রায়ের আগে মারা যান চারজন।
পরে এই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) আসে হাইকোর্টে। খালাস পাওয়া ২৭৮ জনের মধ্যে ৬৯ জনের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। খালাস চেয়ে আপিল-জেল আপিল করেন আসামিরাও। এসব আপিল-জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায় দেন হাইকোর্ট।বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে হাইকোর্ট ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। আটজনকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাঁচ আসামিকে খালাস দেন উচ্চ আদালত।

বিচারিক আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে হাইকোর্ট ১৪৬ আসামির সাজা বহাল রেখে ১৪ জনকে খালাস দেন। এ ছাড়া খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে ৩১ আসামির খালাসের রায় বাতিল করে তাঁদের যাবজ্জীবন এবং চারজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি ৩৪ জনের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বহাল থাকে। সব মিলিয়ে ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন, চারজনের সাত বছরের কারাদণ্ড ও ৫৩ জনকে খালাস দেন উচ্চ আদালত।

এই রায়ের তিন বছর পর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি তুলে আপিল ও লিভ টু আপিল করতে লেগে যায় প্রায় দেড় বছর। পরে পেপারবুক তৈরিতেও সময় যায়।

আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল-লিভ টু আপিল

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের তথ্য মতে, হাইকোর্টের রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে বা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন হয়েছে এমন ৮৩ আসামিদের সাজা বাড়াতে ২০টি লিভ টু আপিল করা হয়েছে। আসামিপক্ষের এক আইনজীবী আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৬৩ জন আসামির পক্ষে ৩৫টি আপিল এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৬২ জনের ৩৩টি লিভ টু আপিল করেছেন তিনি। গত বছর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের সারসংক্ষেপ (কনসাইজ স্টেটমেন্ট) জমা দেয়। এর পর থেকে শুনানির অপেক্ষায় উভয় পক্ষ।

জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আপিল বিভাগে পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক নেই। আশা করছি, বিচারক এলে (নিয়োগ হলে) এর (এই মামলার শুনানির) জন্য আলাদা একটি বেঞ্চ গঠন করা হবে। কারণ এই মামলার শুনানি শুরু হলে অন্য মামলা হয়তো শুনতেই পারবেন না। এ মামলার টানা শুনানি হলেও মনে হয় না দুই মাসের আগে শেষ হবে।’

মামলাটির শুনানি করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আসামিপক্ষের একটি আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় তোলা হয়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারির কার্যতালিকাতেও ছিল। মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আকুল আবেদন, উভয় পক্ষের কথা বিবেচনা করে যদি মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত শেষ করেন, তবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।’

সাক্ষ্যগ্রহণে আটকে বিস্ফোরকদ্রব্য  নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার বিচার 

দুটি মামলা একই সময় হলেও গত ১৫ বছরে শেষ হয়নি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলার বিচার। এটি এখনো অনেক দূরের বিষয়। গত কয়েক বছর ধরে সাক্ষ্যগ্রহণেই আটকে আছে এই মামলার বিচারকাজ। জানা গেছে, এক হাজার ২৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ২৭১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ২৭২তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে এক বছর ধরে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আর কতজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করবে, তা আমাদের এখনো জানায়নি। ফলে বলা যাচ্ছে না সাক্ষ্যগ্রহণ আর কত বছর চলবে। ১৫ বছর ধরে মামলাটির বিচার চলছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যাখ্যা থাকা উচিত।’

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিনের ভাষ্য, সময় কেবল রাষ্ট্রপক্ষের লাগছে না, আসামি বেশি হওয়ায় ওই পক্ষেরও সময় লাগছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘মামলার শত শত আসামির শত শত আইনজীবী। সাক্ষ্য দেওয়ার পর একজন সাক্ষীকে যদি সব আইনজীবী জেরা করেন তাহলে কত সময় প্রয়োজন?’

বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া এবং সাজা খেটে ফেলা সবাই বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার আসামি। ফলে খালাস পেলেও বা সাজা খেটে ফেললেও তাঁদের কারামুক্তি মিলছে না। এমন ৪০ জনের পক্ষে জামিন আবেদন করেও সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান আইনজীবী আমিনুল ইসলাম।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ সংবাদ

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ

0
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে হাজার খানেক শিক্ষার্থী তিতুমীর কলেজ...

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নতুন ডিজি কাউসার নাসরীন

0
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব (সংযুক্ত) কাউসার নাসরীন। সোমবার (১৮ নভেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখার সিনিয়র...

শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত

0
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে পাসগুলোর কার্যকারিতা থাকবে না। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি...

সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গ্রেফতার

0
ঢাকা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার (১৮ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তরা-১২ নম্বর...

‘শেখ হাসিনা নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন, তবে বাস্তবতা ভিন্ন’

0
ভারতে বসে শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যগুলো বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে...