২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি বেসরকারি সংস্থা ঢাকা ফোরামের এক আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেসব পরামর্শ বা ইচ্ছা কাজে আসেনি। বরং ২০১৬ সালের পরও নতুন বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর সাত বছর পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকার্স সভায় একই পরামর্শ দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। দেশের সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় দুর্বল ব্যাংকগুলো ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা এখনই শুরু করুক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র অনুযায়ী, দেশের ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮-১০টি ব্যাংক একীভূত হতে পারে। এ জন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গভর্নর যেদিন এই পরামর্শ দিলেন, সেদিনই পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিস সরাফাতের পদত্যাগের খবরটি পত্রিকায় এল। কিছুদিন আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয় পরিচালকদের সঙ্গে অন্তর্বিরোধের কারণে। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে বাজারে বন্ড ছাড়তে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। প্রতিবছর খেলাপি ঋণের পরিমাণই কেবল বাড়ছে না, ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে বলেও বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।
অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার তাদের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা আমলে না নিয়ে একের পর এক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েই যাচ্ছে। যে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, তঁারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সদুপদেশ শুনবেন বলে মনে হয় না। অনেক উদ্যোক্তা যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেন, তার কয়েক গুণ ঋণের নামে হাতিয়ে নেন। এমনটি চলতে দেওয়া যায় না।
একটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার গভর্নরের পরামর্শের পর ব্যাংকারদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেন ভালো ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নেবে? কিন্তু অনেক দেশেই এই ব্যাংক একীভূত করে সুফল পাওয়া গেছে। এতে ব্যাংকের পরিচালনা ব্যয় অনেক কমে যাবে।
২০২২ সালের ১২ জুলাই গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বছরের ৩ আগস্ট আব্দুর রউফ তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের অগ্রগতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবেন। তারপরও দেড় বছর চলে গেছে। ব্যাংকিং খাতে কোনো সংস্কার হয়নি। বরং বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার যত বিলম্ব হবে, তত এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা আছে। কিন্তু শৃঙ্খলা আনার কথা বলা আর সেটি কাজে পরিণত করার মধ্যে যে বিরাট ফারাক আছে, সেটা দেশবাসী ১৫ বছর ধরে প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?