ইতালির ভেনিস শহরে ছিল এক সওদাগর। নাম তার অ্যান্টনিও। সদা হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল। বিপদ-আপদে অভাবগ্রস্তরা ছুটে আসে তার কাছে। মুক্তহস্ত অ্যান্টনিও কাকেও শূন্যহাতে ফেরায় না চারদিকে তার নামের প্রশংসা।
কিন্তু অ্যান্টনিওর এই যশ-প্রতিপত্তির ধাক্কা গিয়ে লাগে আর একটি অন্তরে। সেও একজন ব্যবসায়ী। তবে সুদের ব্যবসা করে। কাউকে বেকায়দায় পেলে চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। ধার পরিশোধের সময় ঋণগ্রহীতাকে সর্বস্ব খোয়াতে হয়। ভেনিসের মানুষ তাই কেউ তাকে বরদাস্ত করতে পারত না। এই ব্যবসায়ীর নাম শাইলক। জাতে ইহুদি। অ্যান্টনিওকে সংগত কারণেই সে দুচোখে দেখতে পারত না। অপরপক্ষে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অ্যান্টনিও ঘৃণার চোখে দেখত তাকে। সে বিধর্মী বলে নয়। শাইলকের নীতি সম্পর্কে সে বন্ধুমহলে মাঝে মধ্যে কঠোর ভাষায় সমালোচনাও করত।
শাইলক সুচতুর ও অত্যন্ত কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। সে অ্যান্টনিওর ব্যবসার লাভ-লোকসান আর নিজের সুদের ব্যবসা মূলত একই পর্যায়ে বিবেচনা করত।
তবে অ্যান্টনিওর এই উদারনীতির জন্য শাইলকের সুদের ব্যবসার যে বহু ক্ষতি হচ্ছিল একথা মর্মে মর্মে সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। সে মনে প্রাণে অ্যান্টনিওর ধ্বংস কামনা করত।
অ্যান্টনিওর বন্ধুর অভাব নেই। বন্ধুমহলের মধ্যে বাসানিও ছিল তার অন্তরঙ্গ। একদিন ম্লান মুখে এসে অ্যান্টনিওকে জানাল, পোর্শিয়া নামের একটি সুন্দরী যুবতীর বিয়ে হচ্ছে, বহু ধনরত্নের মালিক সে। আর তাকে সে পছন্দও করে। কিন্তু টাকাপয়সা না থাকার জন্য সে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারছে না।
অ্যান্টনিওর বাণিজ্য-জাহাজগুলো তখন সাগরবক্ষে ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরছে-এখনও সেগুলো বন্দরে ফেরনি; তাই সে বন্ধুকে তখন অর্থসাহায্য করতে পারল না। সেজন্য সে বলল, ‘অপেক্ষা করো বন্ধু। বর্তমানে আমার হাতে নগদ কিছু নেই সত্য, তবে তোমার ইচ্ছা পূরণের জন্য আশীর্বাদ করছি।’
কিন্তু তাহলে যে সর্বনাশ হবে। বাসানিও মুষড়ে পড়ে, ‘জাহাজ বন্দরে পৌঁছেনি সে তো আমি জানি। কিন্তু টাকাটা যে এখনই দরকার। পোর্শিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার টাকা আমার তো কোনো উপকার করতে পারবে না বন্ধু।
অ্যান্টনিও বলল, ‘তাহলে কোনো স্থান থেকে টাকাটা ধার নাও। আমি না হয় তোমার জামিন থাকব।’
কিমুত অত টাকা ধার দেবে কে? অনেক ভেবে বাসানিও শাইলকের দ্বারস্থ হলো। বলল, ‘ধনী বণিক অ্যান্টনিও যদি আমার জামিন থাকে তবে কী আপনি আমাকে তিন হাজার ড্যাকাট ধার দিতে প্রস্তুত আছেন? আমি সুদ দিতে প্রস্তুত।’
বাসানিওর কথায় সুদখোর শাইলক তামাটে দাঁত বের করে হাসলেন। এই মোক্ষম সুযোগ। প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্টনিওকে ফাঁদে ফেলার আশায় মন তার চঞ্চল হয়ে উঠল। তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার আর কুৎসা রটানোর প্রতিশোধ গ্রহণের এ সুবর্ণ সুযোগ উপেক্ষা করার যুক্তি সে খুঁজে পেল না।
একবাক্যে টাকা ধার দিতে সে রাজি হলো। মুখে মধুর বুলি আওড়ে বলল, অ্যান্টনিও যখন নিজেই জামিন থাকছে তখন আর সুদ গ্রহণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে কিনা একান্ত পরিহাসছলে একটা শর্ত লিখে দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে অ্যান্টনিওর শরীর হতে শাইলককে এক পাউন্ড মাংস কেটে দিতে হবে।
সুদখোর বুড়ো শাইলকের কথায় বাসানিও চমকে উঠল। কিন্তু অ্যান্টনিও শুনে বলল, টাকাগুলো খুব দরকার। আর তা ছাড়া বাণিজ্য জাহাজ ফিরে এলে এ অর্থসংকট তো আর থাকছে না। তখন শাইলকের মনে কোনো বদ মতলব থেকে থাকলেও সে ব্যর্থ হবে, সে মাংস কেন অ্যান্টনিওর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না।
পোর্শিয়া প্রয়াত বাবার একমাত্র কন্যা। অসংখ্য ধনসম্পদ আর রূপলাবণ্যের জন্য বহু ডিউক ও রাজপুত্রদের নজরে পড়েছে সে। তার পাণিপ্রার্থী হয়ে তাই হাজার যুবকের ভিড়। কিন্তু বাবার নির্দেশমতো পোর্শিয়া মাত্র তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেছে নিল। তার মধ্যে ভাগ্যবান বাসানিও ছিল।