১৯ জুলাই, শুক্রবার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলছিল। উত্তরার দশম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা (১৬) নিজ রুমের ভেতরই আঁকছিলেন প্রতিবাদ চিত্র।
এদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে নাইমার বাসা থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে পুলিশ। সেদিন আব্দুল্লাহপুরে ছাত্রদের ওপর অতর্কিত গুলি চালানোর প্রতিবাদে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের পিএস রানা মোল্লাকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেলের সামনে পিটিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুঁলিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে মেডিকেলের সামনে আসে এবং আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
বাইরে আন্দোলনকারীদের দৌঁড়াদৌড়ি আর গুলির শব্দ শুনে মোবাইল হাতে চার তলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় নাইমা। হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু ভিডিও দৃশ্য ধারণ করছিলেন নাইমা নিজেই।
নাইমার মোবাইলের ক্যামেরায় তখন দেখা যাচ্ছিল দূরের হেলমেট পরিহিত পুলিশ ও অন্যদের ছবি। ভিডিও করে তখনো নিজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের জীবন বাঁচানোর দৃশ্য দেখছিল সে। কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে নাইমার মাথার ঠিক বাম পাশে। নাইমা শুধু ‘মা’ বলে একটি চিৎকারই দিতে পেরেছিল। এরপর যা হবার তাই হলো। দৌঁড়ে গিয়ে দেখলাম নাইমা বারান্দায় পড়ে আছে, মেঝেতে শুধুই রক্ত!
সেদিনের সেই বিকালে মেয়ের মৃত্য নিজ চোখের সামনে দেখে যুগান্তরের কাছে এভাবেই বর্ণনা করছিলেন নাইমার গর্ভধারিণী মা আইনুন্নাহার বেগম।
সেদিনের সেই শেষ বিকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাইমার মা জানান, আমার মেয়েটা তো রাস্তাতে বের হয়নি। ঘরের ভেতর থেকেও ওকে লাশ হতে হলো। ওর মৃত্যু আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শহিদ জননী আইনুন্নাহার বেগম বলেন, বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে নাইমা আমাকে বলল-মা পিৎজা বানাব, ফ্রিজে চিকেন আছে নাকি? চিকেন আছে, এটা শুনার পরই বলল, আচ্ছা বারান্দা থেকে জামা-কাপড় নিয়ে আসি। বাইরে গন্ডগোলের শব্দ শুনে আমি ওকে বললাম বারান্দা থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্য। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়ানোই আমার মেয়ের কাল হলো!
তিনি বলেন, ও (নাইমা) বারান্দায় যাওয়ার কয়েক মিনিট পরই নাইমা ‘মা’ বলে একটা চিৎকার দেয় শুধু। আমি আর আমার বড় মেয়ে কি হইছে? কি হইছে? বলতে বলতে বারান্দায় যেতেই দেখি নাইমা বারান্দার মেঝেতে পড়ে আছে। পুরো বারান্দা তখন রক্তে লাল হয়ে গেছে। আমার মেয়ের রক্ত দেখে আমি বেহুশ হয়ে পড়ি। এর কিছুক্ষণ পরই নিচ থেকে এলাকার ছাত্ররা এসে নাইমাকে মেডিকেল নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে আমার মেয়ে আর জীবিত ছিল না। ওর ঘরে থাকা অবস্থায় নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়।
নাইমার মাথায় আঘাতের কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে মা আইনুন্নাহার জানান, নাইমার মাথার পাশ দিয়ে এসে গুলিটা লাগে। ও সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায়। এমনভাবে মাথায় গুলিটা লাগে যেন মাথার মধ্যে কেউ কোপ দিয়েছিল।
তিনি বলেন, ডাক্তাররা বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ হাসপাতালে রাখার পর দেখলাম ডাক্তাররা আমার মেয়েকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। তখনই বুঝছি আমার কলিজার টুকরা আর দুনিয়াতে নাই।
মেয়ের স্বপ্ন নিয়ে বলতে গিয়ে মা আইনুন্নাহার নাইমার ছোটবেলার একটি ছবি দেখিয়ে যুগান্তরকে বলেন, আমার মেয়েটা বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। এই দেখেন- ছোটবেলায় স্কুলে ও ডাক্তার সাজছে। নাইমা সবসময় বলত-বড় হয়ে গরীব মানুষের সেবা করতে চায়। আমি আর ওর বাবা আমরা সবসময় উৎসাহ দিতাম। কিন্তু সে (নাইমা) আর ডাক্তার হতে পারল না।
আন্দোলনে নাইমার অংশগ্রহণের বিষয়ে মা আইনুন্নাহার বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই ও বাসায় বসে আন্দোলনের পক্ষে আকাঁআঁকি করত। ফেসবুকে ‘বয়কট ছাত্রলীগ’ এর একটি পোস্টার একে নাইমা নিজেই পোস্ট করেছিল।
তিনি বলেন, ওইদিন দুপুরের পর ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নাইমা মোবাইল কল দিয়ে ওর ম্যাডাম আর বান্ধবীদের কাছে আন্দোলনের খবর নিয়েছিল। পরদিন যাতে নিজেও যেতে পারে সেজন্য ফোনে ও কাকে জানি বলছিল- স্কুল থেকে সবাইকে আন্দোলনে নিয়ে গেলে ভালো হতো।
তিনি বলেন, ১৮ তারিখ উত্তরায় অনেক ছাত্র মারা যাওয়ার পর রাতে রুমের ভেতর নাইমা আমাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা মা; আমিও যদি আন্দোলনে গিয়ে মারা যাই, তাহলে আমার মৃত্যুর বিষয়ে তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি কি বলবা?
নাইমার এই প্রশ্ন শুনে আমি বলি-মা তুমি কি বলো এগুলা? তোমারে তো আমরা লেখাপড়া করাইতেছি বড় হওয়ার জন্য। তুমি আমাদের মেয়ে, তুমি আর এইসব কথা বইলো না।
তখন নাইমা বলে ওঠে- না আম্মু, তোমার কথা হয় নাই। আমি যদি মারা যাই তখন বলবা, আমার মেয়ে শহিদ হইছে। এ সময় কেঁদে উঠে আইনুন্নাহার বেগম বলেন, ওর এই কথাগুলো আমার কানে এখনো বাজতেছে।
মেয়ের কোন স্মৃতিগুলো সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে জানতে চাইলে আইনুন্নাহার বেগম যুগান্তরকে বলেন, নাইমার বড় বড় চোখ ছিল। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ওর সবকিছুই আমার মনে পড়ে। সে শহিদ হওয়ার পর থেকে আমি ঠিকমতো কিছুই করতে পারি না।
নাইমার দাফন-কাফনের বিষয়ে মা আইনুন্নাহার বলেন, রাতেই ওর মামা-চাচারা গ্রাম থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের উত্তর মতলবে যাওয়ার পথে পথে আমাদেরকে আটকায় বিভিন্ন মানুষজন। পরদিন (শনিবার) সকাল বেলা আমুয়াকান্দি গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে নাইমাকে দাফন করা হয়।
নিজ মেয়ের খুনীদের বিচার চেয়ে শহিদ নাইমার মা বলেন, আমি চাই খুনীদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচার করা হোক। আমার মেয়েটা ঘরে থেকেও রক্ষা পায়নি। যারা সেদিন গুলি চালিয়ে আমার নিরপরাধ মেয়েটাকে খুন করেছে আমি তাদের বিচার চাই।
নাইমা হত্যায় শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীদের অভিযুক্ত করে আইনুন্নাহার বেগম বলেন, ওই স্বৈরাচারী সরকার যেন এদেশে আর ফিরে না আসে। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। খুনীদের বিচার করা হোক।