যোগ্যতার ভিত্তিতে নারীর প্রাপ্য স্বীকৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ, রাজনীতিতে ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোতে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তরুণীরা কী ভাবছেন। লিখেছেন–রীতা ভৌমিক
g বার্তাগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া: রাফিয়া রেহনুমা
নতুন বাংলাদেশে আমরা রাষ্ট্র নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। বর্তমানে যারা দায়িত্বশীল পর্যায়ে রয়েছেন, সেখানে তারা যোগ্যতার বলেই অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এ সময় সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া প্রয়োজন, সেই বার্তাগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাহলেই মানুষের কল্যাণে তারা পদক্ষেপগুলো নিতে পারবেন। সেই পদেক্ষেপ নেওয়ার সদিচ্ছা তাদের মধ্যে রয়েছে। বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা।
রাফিয়া রেহনুমা বলেন, বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গোড়া থেকে করতে হবে। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী নেত্রী দুজন নারী ছিলেন। তৃণমূল থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীরা বৈষম্য থেকে কখনো মুক্তি পাননি। সুতরাং বাংলাদেশে সত্যিকারের নারীর ক্ষমতায়ন কখনো হয়েছে কি না? এই প্রশ্নটা এখনো থেকে যায়। বাংলাদেশে বড় বড় পদে নারীরা যখন পৌঁছেছে, সেটার মাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, সেটা পুরো ভুল ধারণা। তৃণমূলের নারীদের কথা কখনো উঠে আসে না, যেমন গার্মেন্ট কর্মীরা যারা কাজ করে সংসার চালায়, সেই নারীদের আদৌ কোনো ক্ষমতায়ন হয়েছে? এর কারণ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন মানে নারীর ক্ষমতায়ন না। তিনি যে অর্থ রোজগার করছেন, তা ঘরে গিয়ে নিজে খরচ করতে পারছেন কি না? নাকি স্বামীর হাতে তুলে দেয়? সংসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের স্বাধীনতা রয়েছে কি না। নারী অধিকার বা রাষ্ট্র সংস্কার গোড়া থেকে হওয়ার দরকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নারীদের রাজনৈতিক সংকট অনেক বেশি। নারীকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার জায়গা করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে লড়াইটা নারীর নিজেকেই করতে হবে। যে কোনো সম্প্রদায়ের নারীদের কথা তুলে আনার জন্য রাজনৈতিক স্টেক থাকা দরকার; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের কথা বলার কোনো স্টেক নেই। নারী যে রাজনীতি করেন তা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে থেকে রাজনীতি করেন। পুরুষের ভয়েসে কথা বলেন, পুরুষের চিন্ত-ভাবনা তার মধ্যে বিস্তার করে। এ জন্য রাজনৈতিক স্টেকটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত নারীদের স্বকীয় রাজনীতি গড়ে না উঠবে, নারীরা পুরুষের দৃষ্টিতে রাজনীতিকে দেখবেন না, নিজের স্বকীয় দৃষ্টি থেকে তার পাশে থাকা নারীসহ দূরের নারীদের কথা তিনি যখন বলতে পারবে, তখন মনে করব নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হবে। গাজীপুরের মেয়ে রাফিয়া রেহনুমার মতে, অন্যদিকে নারী আন্দোলনের কথা যদি বলি তাহলে, মূলত সফল নারীদের পাশে নিয়ে আমাদের এগোতে হবে। নারীবান্ধব পরিবেশে নারীর ক্ষমতায়ন হওয়া সম্ভব। একজন মানুষ স্বাধীন তখন হবে পোশাকের স্বাধীনতার পাশাপাশি তার চিন্তাধারার স্বাধীনতা থাকবে। পোশাকের স্বাধীনতার চেয়েও অনেক জরুরি আমার জীবনের সিদ্ধান্তটা আমি নিতে পারছি কিনা! আমার পরিবার থেকে আমাকে চিন্তা করার জায়গাটা দিচ্ছে কিনা?
g অধিকাংশ নারীর অংশগ্রহণ ছিল: অর্পিতা গোলদার
আমরা নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে যখন কথা বলি, যেমন রাষ্ট্র সব নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কী কী করেছে। সেই জায়গাটা তৈরি করেছে কিনা? এই প্রশ্ন যখন উত্থাপন হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটি স্লোগান ছিল, ‘আমি নারী, আমার কোটা দরকার নেই’। এখানে বলা যেতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের কোটা দরকার না হলেও, শুধু নারী হওয়ায় নীলফামারীর যে মেয়েটি দশ বছরে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, সেখানে নারী কোটা দরকার নেই বলে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেললাম, এটা সমর্থন করা যায় না বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী অর্পিতা গোলদার।
তিনি বলেন, চলতি বছরের ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপনটা যখন জারি হলো, নারী কোটা কেন বাতিল করলেন, সাবেক আইনমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, ‘নারীরাই বলেছেন। নারী কোটা দরকার নেই।’
নারীর প্রতি বৈষম্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সব জায়গা থেকেই হয়। নারীরাও এই বিষয়টি অবগত নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরাই নারীদের সামনে এগিয়ে দিতে চায় না। রাষ্ট্রে যারা নীতি নির্ধারণীতে রয়েছেন, তারা নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে সব নারীর জন্য কথা বলতে তেমন দেখা যায় না। একজন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, একজন স্পিকার নারী নেতৃত্বে থাকা মানেই এই নয়, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। খুলনার মেয়ে অর্পিতা গোলদার বলেন, পেছনের সারির নারীদের জন্য কোটা ছিল। এর মাধ্যমে সমাজের তাদের উঠিয়ে আনার উদ্যোগ ছিল। পরবর্তীতে যখন সংস্কার করা হলো, সেই বিষয়টি পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীর যারা কোটার আওতায় ছিল, তাদের নিয়ে সামনাসামনি একটি সংলাপের মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। সেটা না করে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এই কোটার যৌক্তিকতা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নারীরা রয়েছে তারা যাতে পূর্ণ পরিবেশ পায়। তিনি বলেন, যখন কর্মক্ষেত্রে তারা আসতে চায়; কিন্তু সেই দক্ষতাগুলো তারা অর্জন করতে পারে না। দেশি বা বিদেশি পর্যায়ের চাকরিতে তারা যোগসূত্র তৈরি করতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র থেকে তাদের উঠে আসার জায়গাটি দেওয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী নিয়ে যখন কথা বলা হয়, সব কিছু নিয়ে সংস্কারের কথা বলা হয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আমরা এখনো দেখতে পাইনি।
অর্পিতার মতে, এর কারণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অধিকাংশ নারীর অংশগ্রহণ ছিল। আমরা যখন মানুষজনকে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলার চেষ্টা করি, তখন অনেকে বলেন, তারা কেন কথা বলবে! আমাদের কর্নার করে দেওয়া হয়। এ থেকে বলা যেতে পারে, কখনো বলা যাবে না, নারীর প্রতি বৈষম্য হয় না। তবে আমার পরিবারে কখনো মেয়ে বলে বৈষম্যের শিকার হইনি।
g নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয়নি: নিশিতা জামান নিহা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আমরা সবাই অংশগ্রহণ করেছি। মেয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল বলেই ভাইয়েরা সাহস পেয়েছেন। আন্দোলন সফল হয়েছে; কিন্তু আন্দোলন সফল হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয়নি। স্বীকৃতি পাওয়ার সময়টি যখন আসে, তখন নারীরা স্বীকৃতি পায় না। তাদের পিছিয়ে রাখা হয়। এই জায়গাগুলোতে কাজ করার রয়েছে বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিশিতা জামান নিহা।
তিনি বলেন, দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। এটি শুধু আইন করে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর কারণ আইনটি প্রয়োগ করা হয় না। শিশু থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণ থেকে বাদ যায় না। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, একজন শিশু স্কুল থেকে ফেরার পথে তার প্রতিবেশী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একজন ষাটোর্ধ্ব নারী চারুকলার উল্টোদিকে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় বেশির ভাগই দেখা যায়, একজন নারী বা কিশোরী বা মেয়েশিশু রাতে একা ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে যখন মামলা করতে যাওয়া হয়, থানা মামলা নিতে চায় না। আবার ভিকটিমদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করা হয়। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মৌমিতার ঘটনায় বলা হয়েছিল, এত রাতে একজন মেয়ে কেন বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘরে গেল। এই ঘটনাগুলো দেশ-কাল-পাত্রভেদে সব জায়গায় একইরকম। মামলা করলেও এর নিষ্পত্তি হয় না। এই মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে। অভিযুক্তরা আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। অপরাধীর বিচার হয় না।
সাতক্ষীরার মেয়ে নিশিতা জামান নিহা বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্য সব জায়গায় রয়েছে। যারা সচেতন তাদের মধ্যেও এই ধারণাটা রয়েছে। কারণ তারা বুঝতে পারে, দেখতে পারে; কিন্তু এই বিষয় নিয়ে কাজ করার জায়গাটা খুবই সীমিত। বৃহত্তর পরিসরে এটা নিয়ে কাজ করা দরকার। সমাজে নারীর পরিবর্তন হচ্ছে। এক সময়কাল থেকে যখন আরেক সময়কালে যাওয়া হয়, অর্থাৎ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে যায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন আসে। এখন যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটা নারীদের খুব বেশি উন্নতি ঘটাচ্ছে বলে মনে করি না। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিছু জিনিস খুবই চরম পর্যায়ে রয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নারী অধিকারের কথা বলা হলেও, যে মেয়েরা উঠে এসেছে বা সুযোগ পাচ্ছে তারা আগে থেকেই প্রবলভাবে এগিয়ে রয়েছেন। এর বাইরে যে বড়সংখ্যাক মেয়েরা রয়েছে, তাদের নিয়ে সেভাবে কাজ করা হচ্ছে না। তাদের দিকে এখন ফোকাস দেওয়া দরকার। তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে।