27 C
Dhaka
শনিবার, অক্টোবর ৫, ২০২৪

সিসিফাস

এই ভোরে বৃষ্টি নামার পর থেকেই ওর মনে হতে লাগল, বোধ হয় ও মরেই যাবে আজ। লাল বেঢপ নাক নিয়ে এমনই এক ভোরে পৃথিবীর এক স্যাঁতসেঁতে, গুমোট ঘরে ও জন্মেছিল। ততক্ষণে বাইরের ভ্যাপসা গরম আর ছিনালি ঝিরঝির বৃষ্টি ইঁদুরে খাওয়া পাউরুটির মতো গ্রামকে যেন নরক করে তুলেছে। পুত্রের আগমনে ওর উৎকণ্ঠিত প্রৌঢ় বাপ তড়িঘড়ি করে আজান দিতে গিয়ে দেখলেন, কানে অর্ধেক খাওয়া একটা বিড়ি গোঁজা। সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলেন মুহূর্তের জন্য। তবে শেষমেশ পুত্রের মঙ্গলের কথা ভেবে বিড়িটা ছুড়ে ফেললেন বাইরে বৃষ্টির মধ্যে। তারপর আজান দিতে থাকলেন খকখক কাশতে কাশতে, যতক্ষণ না পুত্রের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান।

এত বছর পর আজ এই বৃষ্টিমুখর ভোর ওকে টেনে নিয়ে গেল উঠোনের কোণের সেই ভেন্নাগাছতলায়, যেখানে মা একঘেয়ে জন্মের অভিশাপ নিয়ে কষ্টের ধানগুলো বৃষ্টির হাত থেকে শেষ রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে। যেভাবে নিরীহ শজারু তার তীক্ষ্ণ কাঁটা নিয়ে বাঘের ধ্বংসাত্মক মাংসাশী থাবা থেকে নিজেকে নিষ্ফল বাঁচানোর চেষ্টা করে।

 

আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে ও সব সময় ভয়ে গুটিসুটি মেরে যেত, যেমন বিপদে কেন্নো পেলব পয়সা হয় । মনে হতো আকাশ বুঝি লম্বা লেজ পেঁচিয়ে ওকে তুলে নেবে, তারপর ছুড়ে ফেলবে হাটের রাস্তায় বটগাছটার ওপর, যেখানে এক সন্ধ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাট থেকে ফিরতে ফিরতে ওর বাপ ওকে আচমকা ঠেলে দিয়েছিল বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে। হাটের ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘চুপ করি বয়, আমি এট্টু হেগি আসি।’ একটা ভীষণ তাড়াহুড়ার মধ্যে ভূতের মতো তিনি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন পাশের ঝোপের ভেতর।

‘আব্বা কনে গেলি।’ ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল গা ছমছমে অভয়বাণী, ‘এট্টু চুপ করি বয়। আমি আছি তো।’ হাটের ব্যাগ নিয়ে বসে বসে থরথর কাঁপতে কাঁপতে ও ভিজিয়ে ফেলেছিল ওর প্যান্ট।

প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলা নতুন কিছু ছিল না ওর জন্য। আট বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন বারান্দার খুঁটি ধরে ও যখন উঠোনের প্রতিটা গুবরেপোকার গর্তে সেচের সমবণ্টন করত, তখন ঘুমের ভেতর ওর জীর্ণ কাঁথাটা ভিজে এলিয়ে পড়ত ছানার জিলাপির মতো। তাই ছয় মাস বয়সে নিজের তিন গুণ দূরত্বে প্রস্রাব করে প্রতিবেশীদের তাক লাগিয়ে পাওয়া ‘বাঘা’ নামটা তত দিনে প্রস্রাবে ভিজে ভিজে একটা আস্ত মুখভর্তি দাড়ি গজানো ধাড়ি ছাগল হয়ে উঠেছে।

 

এসব কথা ভেবে আজ ওর মাথা খানিকটা ঝিমঝিম করে উঠল। দেখতে পেল, বিছানায় নেতানো দাদি নিচের ঠোঁট চিত করে একমুঠো তামাক পুরতে পুরতে বলছে, ‘ও রে আপছার, তোর চোকে কি কেতু পুকা পড়িচে, কুকরু ধানগুনু খেয়ি ফেল্লু আর তুই সারাডা দুনিয়া বাড়া নাচাই বেড়াচ্চিস।’

জন্মের পর দাদি বাঁশের চাঁচ দিয়ে নাড়ি কেটে অপুষ্ট, ক্লান্ত এই শিশুর মুখে দুর্গন্ধ থুতু ছিটাতে ছিটাতে গদগদ সুরে বলেছিল, ‘এ ব্যাটার নাম রাকলাম আপছার মিয়া।’

‘ন্যাস্টি ওল্ড ফিলো, একটা শিশুর নাম কখনো আফছার মিয়া হয়!’ আশি বছরের ছাপ লাগানো এই নাম ওকে বিড়ম্বনা দিয়েছে সারা জীবন। গত পরশু নেহাল সাহেবের বাসায় গেট টুগেদার পার্টিতে মিসেস আফছার বলার পর থেকে প্রিয়ন্তী ওর শয্যা ত্যাগ করেছে।

এখন আফসোস হলো, অন্তত বাঘা নামটা থাকলেও মন্দ হতো না। ‘মিসেস বাঘা’ চমৎকার মানাত!

এখন আকাশ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি বিয়োচ্ছে বেহায়ার মতো। আফসার মিয়ার ইচ্ছা করল তেল চিটচিটে কলাপাতা রঙের সেই জীর্ণ বহুবর্ষী শার্টটা দিয়ে আকাশকে মুড়িয়ে দিতে। শার্টটা পরার পর আফসার মিয়ার মাথায় শুধু একটা স্বপ্নই সারাক্ষণ ঘুরপাক খেত, কবে সেটা খাটো হয়ে ওর গায়ে মানানসই হবে।

শার্টটা পরলে ওর গোড়ালি থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সুস্পষ্ট দেখা যেত! ওর মা খুশি হয়েছিল আরও বেশি। কারণ, পরবর্তী কয়েক বছর তাকে আর প্যান্টের চিন্তা করতে হয়নি।

একটা চমৎকার ফুলের নকশা ছিল শার্টটাতে। শার্টের শেষ প্রান্ত যেটা ওর গোড়ালিতে গিয়ে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে একটা লতা পেঁচিয়ে উঠেছিল ওর কোমর পর্যন্ত, তারপর শাখা গজিয়ে একটা গিয়েছিল পিঠের দিকে; আর একটা উঠেছিল ওর গলা পর্যন্ত মস্ত বড় ফুল নিয়ে। শার্টটা পরার পর আফসার মিয়া প্রতিবার ফুলটা থেকে যেন একটা আলাদা গন্ধ পেত। আর গন্ধ যখন চরমে উঠত, তখনই কেবল সেটাকে চুবানো হতো ক্ষার আর গরম পানিতে।

আফসার মিয়ার সেই স্বপ্নের ঘোর কেটেছিল অনেক দিন পর, যেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল, হেরমত নাপিত ঊরু পর্যন্ত লুঙ্গি তুলে দুই হাঁটু ফাঁক করে সাইকেলের একটা পিতলের বেলের প্রাগৈতিহাসিক বাটিতে ক্ষুর আর ফিটকিরি চুবিয়ে ওর অপেক্ষায় বসে আছে। একঝটকায় ওর মাথাটা চালান করে দিয়েছিল দুই হাঁটুর ফাঁকে। আফসার মিয়া বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিল হেরমতের বিষণ্ন বাদুড়ঝোলা জগতের দিকে।

আট সন্তান জন্ম দিয়ে ওর মা হাঁপিয়ে উঠেছিল। মায়ের শীর্ণ টোপলা খাওয়া মলিন হাঁড়িমুখটা ভেসে ওঠে আফসার মিয়ার সামনে।

ছাগলের মুখে দুটো কাঁঠালের ডাল কেটে দিয়ে মা চুলোয় পোয়াখানেক চাল বসিয়ে দিয়েছেন। ভাতের হাঁড়িটা এমন বেঢপ বড় ছিল যে চালগুলো ঢাললে ওটা যেন সুড়সুড়ি পেত কেবল। উষ্ণ আর শীতল স্রোতে ঘোল মেরে চালগুলো ভেসে বেড়াত যেন মহাসমুদ্রে।

খাওয়ার সময় রীতিমতো যুদ্ধ বেধে যেত ভাতের ফ্যান নিয়ে। আর যুদ্ধে সবচেয়ে অসহায়ভাবে পরাজিত সৈন্যকে মা পরম মমতায় তুলে দিতেন তার নিজের ভাগের সামান্য ফ্যানটুকু।

এখন দেশবিখ্যাত আফসার মিয়া গলায় ন্যাপকিন ঝুলিয়ে স্যুপে চুমুক দিতে গেলেই দেখে একঘেয়ে কাঁঠালপাতা ছেড়ে ছাগলটা ওর দিকে তাকিয়ে ম্যা…ম্যা… করে ডাকছে।

মায়ের মৃত্যুর সময় আফসার মিয়া মাকে যেন ঠিকমতো চিনতে পারছিল না, মুখটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে থেকে কালো হয়ে যাচ্ছিল। বাইরে তখন মাতাল সূর্য আগুন ছুড়ছে। সেবার মাঠ ফেটে পড়েছিল পাকা ঢ্যাপের মতো। ধানের শিষগুলোর তখনো ঠিকমতো চোখ ওঠেনি। গর্ভ থেকে মাথা তুলে মাত্র বাতাস শুঁকতে শুরু করেছে।

কদিনের মধ্যেই যেন ভাগাড় হয়ে উঠেছিল সমস্ত মাঠ। অকালে ভূমিষ্ঠ মৃত শিশুর মতো শিষগুলো মরে শুকিয়ে উঠল কিন্তু পচতেও পারল না!

আফসার মিয়া দেখল, নোনা গাছতলায় একটা ছেঁড়া খেজুরের পাটিতে শুয়ে মা হিক্কা তুলতে তুলতে সারা বাড়ি মাথায় করে তুলেছেন। হিক্কার সঙ্গে বারকয়েক রক্ত বেরোল। তারপর বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মা।

ওর বাপ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল পরের শীত আসতে আসতে। তত দিনে তিনি প্রতিদিন গোসলের সময় মাথায় এঁটেল মাটি ঘষতে শুরু করেছেন। আর যেদিন আতরে চুবানোর জন্য তুলার খোঁজে বালিশ ফুটো করতে গিয়ে ধরা পড়লেন, সেদিন সদ্য গোঁফ গজানো বালকের মতো ঘড়ঘড়ে গলায় তিনি বলেছিলেন, ‘এই ঠান্ডায় খ্যাতার মদ্দি এট্টা পুরুষ মানুষ কী করি থাকে, একলা থাকলি কী খ্যাতা গরম হয়!’

মায়ের মৃত্যু ও বাপের বিয়ের পর আফসার মিয়া একটা নিজস্ব জগৎ পেয়েছিল। কারণ, মায়ের কঞ্চি হাতের চড় যেমন সকাল-সন্ধ্যা আর খেতে হতো না, বাপও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আলতাফ কবিরাজের কাছ থেকে লতাপাতার পাচন নিয়ে তাজা বউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে।

আফসার মিয়া ভেলভেটের পর্দাটা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করল বৃষ্টি কমেছে কি না? কিন্তু এখনো বৃষ্টির এমন মেজাজ যেন অনন্তকাল ধরে সে আফসার মিয়াকে নিঃশেষ করতে থাকবে।

 

আফসার মিয়া এই পতন থেকে বাঁচতে অন্যদিকে মনোযোগ দিল। বেলজিয়াম থেকে আনানো পিওর মিনারেল ওয়াটার ঢালল গ্লাসে। তারপর তাতে একটা চুমুক দিল আভিজাত্যের সঙ্গে। ‘ডে শিডিউল’ বুক বের করে আগামীকালের কর্মসূচিগুলো দেখতে লাগল। কিন্তু যখন বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল, তখন ও সবকিছু ছুড়ে বসে পড়ল দুকানে আঙুল দিয়ে। এভাবে কতক্ষণ ও বসে থাকবে, জানে না।

হয়তো মা ওকে খুঁজছে, চৌকির নিচে, যেখানে ঝোলা গুড়ের ভাঁড়টা কাত হয়েছে মাত্র। আফসার মিয়া দেখল, চতুর্দিক থেকে সার বেঁধে ধেয়ে আসছে পিঁপড়ার দল। অজস্র পা চেপে ধরল ওকে, শত শত কামড় পড়ল ওর অসহায় চোখের পাতায়, কানের নরম গোলকধাঁধায়। দলের সবচেয়ে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পিঁপড়াগুলো হাতে টর্চ না নিয়েই ঢুকে পড়ল ওর নাকের অন্ধকার সুড়ঙ্গে। ক্ষুধার্ত পিঁপড়াগুলো দৌড়
দিল ওর পিঠের নিচে, যেখানে গুড়ের অলস স্রোত একটু বাধা পেয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিল। আফসার মিয়া দেখল, লাখ লাখ পিঁপড়া ‘আলীরে আলী, হেঁইয়ো’ স্লোগানে ওকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারে।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ সংবাদ

তারাও কি হিমায়িত হতে পারে

0
শিল্পীর চোখে কৃষ্ণগহ্বররয়টার্স নতুন এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল আসলে হিমায়িত তারা হতে পারে। এ–সংক্রান্ত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ব্ল্যাকহোল তেজস্ক্রিয়া বিষয়ে একটি প্যারাডক্সের...

গৌরীপুরের সিধলং বিলে লাল শাপলার রাজত্ব

0
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সিধলং বিল ‘শাপলার রাজ্য’ নামে পরিচিত। গৌরীপুরের সিধলা ইউনিয়নের বিলটিকে ‘সিধলা বিল’ নামেও চেনে লোকে। বর্ষায় এই বিল সেজে ওঠে লাল–সাদা শাপলায়।...

“দ্বিধার প্রতিধ্বনি”

0
নিশ্বাসেরও কোনো ভরসা নেই, মুহূর্তে থেমে যাবে বোধহয়। চঞ্চলতার মাঝে লুকিয়ে থাকে, জীবন যেন মিছেই খেলায় রত। বিশ্বাসেরও বিশ্বাস নেই, মানুষের মনে দ্বিধা খেলে। কেউ পাশে থাকে, আবার কেউ মুছে যায়...

সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হোক

0
ফাইল ছবি সারা দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মঙ্গলবার রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে জানানো...

ট্রেন্ড পূজার আয়োজনে হৈমর শাড়ি

0
দরজায় কড়া নাড়ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। এ উপলক্ষে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে এসেছে বর্ণিল ও আকর্ষণীয় উৎসবের পোশাক। দেশীয় অনলাইনভিত্তিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড হৈমর পূজার কালেকশনে এ...